নারীর চাওয়া- সমাজের ভাবনা ....✍ রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক




গল্প

নারীর চাওয়া- সমাজের ভাবনা

রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক


এবারের নারীদিবসের থিম্ ‘ব্যালান্স ফর বেটার’। কিন্তু, আমাদের রোজকার সাংসারিক জীবনে সেই জেন্ডার ব্যালান্স আমরা কতটা বজায় রাখার কথা ভাবি!
প্রয়াত প্রখ্যাত কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত , তাঁর 'আপনি বলুন,মার্কস' কবিতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন---

“ গৃহশ্রমে মজুরি হয় না বলে
মেয়েগুলো শুধু ঘরে বসে বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে!”



গৃহশ্রমে মজুরি হয় না বলে, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, সংসারে হাড়-ভাঙ্গা খাটুনি খাটা মা-মাসি-কাকিমা-বৌমাদের শ্রম কোন ধর্তব্যের মধ্যেই পরে না। তাঁদের নারীবুদ্ধি শিরোপা পায় এই নামে যে ,'অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী’। অথচ,এই নারীকেই আনন্দদায়িনী, কল্যাণময়ী মূর্ত্তি স্বরূপা বলে পূজা করা হয়। কিন্তু ,সে পূজার কোন নৈবেদ্য ,কোন অর্ঘ্য ,কোন সম্মান সাধারণ ঘরের নারীরা বাস্তবে নিজেদের জীবনে তেমন করে পান কী,কেবল খাওয়া-পরার নিশ্চিত জোগানটুকু ছাড়া! একজন নারীর সারাটা জীবন ধরে পিতা-পতি-পুত্র রূপে শেষ সিদ্ধান্ত কিন্তু পুরুষরাই নেন।সংসারে খুশীর বাতাবরণ বজায় রাখাটা একমাত্র নারীরই যেন অলিখিত দায়িত্ব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জীবনস্মৃতি' কাব‍্যগ্রন্থের ‘বিলাত’ প্রবন্ধে একটি লাইন পাই--"অবকাশের কালে আমোদ-প্রমোদ কে জমাইয়া তোলা সেটাও গৃহিণীর কর্ত্তব্যেরই অঙ্গ।" পুরুষ নির্দিষ্ট প্রতিটি সিদ্ধান্ত হাসিমুখে মেনে নেওয়া ব্যতীত সংসারে শান্তির বাতাবরণ আসবে কী ভাবে! অতএব, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ এই প্রবাদ বাক্য নারীকে ভালো ভাবে মাথায় পুরে নিতে হবে।



কিন্তু ,আজকের যুগের নারীসমাজ 'সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে'----এই লক্ষ‍্যকেই ধ্রুবতারা করে জীবন অতিবাহিত করতে অরাজী। তাঁরা চান আত্মপ্রতিষ্ঠা,আত্মমর্য্যাদা,সর্বোপরি self-identity বা নিজের পরিচয়ে পরিচিতি।নিজ সত্ত্বার বিকাশ চায় নারী।নিজের ভিতরের সৃজনশীল গুণের পরিপূর্ণ প্রস্ফুটন চায় তাঁরা। সংসারের সব দায়িত্ব,সব কর্ত্তব্য কে অবহেলা বা অস্বীকার করে নয়, সাদরে শিরোধার্য‍্য করেই তাঁরা পেতে চান নিজেদের আপন আপন জীবন দর্শনের সৌরভটুকু।নিজস্ব মতামত জানানোর অধিকারটুকু। ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের কিঞ্চিৎ মর্যাদা,সম্মান।পুলওয়ামা কান্ডে নিহত কর্ণাটকের শহীদ জওয়ান এইচ. গুরু -র স্ত্রী ‘কলাবতী’-র কথাই ধরা যাক। বিবাহিত জীবন মাত্র দশ মাসের। সদ্য বিধবা হওয়া কলাবতীকে তাঁর দেওরের সাথে বিয়ে দিতে চাইছেন তাঁর শ্বশুর বাড়ির লোকজন। কারণ,তাহলে শহীদের স্ত্রীর ভাতাপ্রাপ্তি বন্ধ হবে না ।আর ,কলাবতী যদি অন্য কোথাও বিয়ে করেন তাহলে কলাবতীর ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে,সে অর্থ পরিবারের লোকেদের হাতছাড়া হয়ে যাবে।( দেওর বা ভাসুর কে বিয়ে করলে ভাতা বন্ধ হবে না --- ভারত সরকারের আইন)তাহলে ,কলাবতীর ব্যক্তিগত ইচ্ছের কী কোন দাম নেই! শুধুমাত্র শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের চাপে পড়ে কিছু অর্থ প্রাপ্তির জন্য ভাই রূপে দেখা দেওরটিকে বিয়ে করতে হবে ! নারী সত্তার এই বুঝি যোগ্য পাওনা, উপযুক্ত পরিণতি!
পেপার খুললেই চোখে পড়ে ,রাস্তার জঞ্জাল,আবর্জনা, নর্দমার পাশে ফেলে যাওয়া প্লাস্টিকে মোড়া মৃত কন্যা সন্তানের উপস্থিতির কথা। হায়, কন্যা সন্তান আজও এত অবহেলিত, উপেক্ষিত, অনভিপ্রেত!
'পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্য্যা'--- একথাই কী তবে এখনো সত্য হয়ে চরম নির্লজ্জতা প্রদান করছে না আমাদের!



নারীরা প্রেরণা প্রত্যাশা করেন নিজেদের পতিদের থেকে,কাছের মানুষদের থেকে ,যাতে,রোজকার অভ্যন্তরীণ জীবনে তাঁর অস্তিত্ব মর্যাদা পায় কেবল সংসারের কাজ বা পরিষেবার জন্য নয়,একজন বিচারবুদ্ধি সম্পন্না মানুষ হিসেবে।
হে,আজকের যুগের উদারমনস্ক পুরুষ (এমনটাই দাবি করেন তাঁরা),আপনারা কি ,পরিবারে নিজেদের স্ত্রী-দের যথাযোগ্য সম্মান প্রাপ্তির মানসিক খিদেটুকু মেটাতে আরো একটু উদার হতে পারবেন না ?পারবেন না বলতে---আমি আছি তোমার সাথে, তুমি চলো এগিয়ে তোমার স্বপ্নের পথে,করো তোমার লক্ষ্যপূরণ!আমরা কন্যা সন্তানকেও পুত্র সন্তানের মতোই সাদরে গ্রহণ করতে আর কবে পারবো? আর কবে নারী শক্তির বিকাশে নিজেদের কল্যাণকামী সাহায্যের হাতখানা বাড়িয়ে দিতে পারবো! নারী দিবসে নারীদের অভিনন্দন জানানোর সাথে সাথে এসব ভেবে দেখার যে একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন সমাজের বোধোদয়ের।

সমাপ্ত
--------------------
ভাষাপথ অ্যাপটি ব্যবহার করবার জন্য ধন্যবাদ। এই অ্যাপটি ভালো লাগেল, অবশ্যই ফাইব ষ্টার রেট দেবেন এবং কমেন্ট করে আপনাদের মতামত জানাবেন এবং সকলের সাথে শেয়ার করে নেবেন।