ধূসর জলছবি .....✍অর্পিতা সরকার
গল্প
ধূসর জলছবি
অর্পিতা সরকার
চলো চলো ..অন্তঃক্ষরী অনেক হয়েছে এবার সামথিং নিউ ট্রাই করা যাক। লাফিয়ে বলে উঠেছে ঐশী। বাবা-মা ,মাসি-মেসোমশাইয়ের সাথে শীতকালীন ট্যুর টা বেশ জমেই উঠেছে। মাসির ছেলে রাজদা গিটারে ওয়েস্টার্ন মিউজিক বাজিয়েছে,মাসি আর ঐশী বেশ কিছুক্ষণ খুব নেচেছে।
মা আর মাসির মধ্যে যেন হেল এন্ড হেভেনের ডিফারেন্স।
ঐশীর মা শোভনা যেন সুনামিতেও ঢেউ না ওঠা ধীর দীঘির শান্ত জল। আর মাসি রমলা হলো, ঘোর নিশ্চুপ বাতাসেও খরস্রোতা।
ঐশী ছোট বেলায় বলতো, মা আর মাসির মধ্যে পাল্টাপাল্টি করে নেব। ধুর মাটা একটুও কথা বলে না। আর মাসিমনি বকবক করে ঐশীর মতোই।পরে ও খেয়াল করেছিল ,এই কথাতে ওর নিশ্চুপ মায়ের মুখে কোনো কথা ফোটেনি ঠিকই কিন্তু দুচোখে নেমেছিল একটা কষ্টের ছায়া।
ঐশীর বাবাও ভীষন রাশভারী একটা মানুষ। কর্তব্য আর নিজের কাজের বাইরে কোনো জগৎ নেই তার। বাবার পছন্দ বলতে একলা ঘরে,অন্ধকারে গান শোনা। রামনাথ মিত্রের এক এবং অদ্বিতীয় শখ ওই গান শোনার বিলাসিতা।
ঐশীর সবে ক্লাস ইলেভেন। এত ছোট বয়েসে দুজন গুরুগম্ভীর মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে ও হাঁপিয়ে ওঠে। তখন মাসী মেসমশাই আর রাজদাই ওর ভরসা। রাজদার প্ল্যানেই এই উইকেন্ডের ট্যুরটা। দারুন এনজয় করছে ঐশী। আজ বাবাও অংশ নিয়েছে অন্তঃক্ষরীতে। বাবার ভারী গলায় দুলাইন গান শুনতে খুব ভালো লেগেছে ঐশীর।
রাজ বললো, কি খেলবি বল...
মাসিমনি চেঁচিয়ে উঠে বললো,আমাদের ছোট বেলার একটা খেলা হয়ে যাক।
ফুল-ফল-নাম-দেশ।
একই অক্ষর দিয়ে ফুলের নাম,ফলের নাম,মানুষের নাম আর দেশের নাম বলতে হবে সবাইকে।
যেমন ধরো-ক এ কলকাতা,কাকন, কলা,কদম।
রাজ গিটার রেখে মায়ের কাছে বসে বললো, মা এটা কিন্তু দারুন ইন্টারেস্টিং।
শোভনার মুখে হালকা হাসি। তোর মনে আছে রমলা,আমরা খাতার পিছনে লিখে লিখে খেলতাম।
শুরু হয়ে গেছে খেলা।
'ঐ' দিয়ে শোভনা নাম বলে ফেললো,ঐকতান। ঠোঁট ফুলিয়ে ঐশী বললো,মা ..তোমার একবারও আমার নামটা মনে পড়লো না! একটু যেন লজ্জাতেই মুখ নিচু করলো শোভনা। ঐশীর মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অজানা ভয়। ঐশী বাদ দিয়ে মা কেন ঐকতান বলে বসলো। হয়তো এমনি...হয়তো হঠাৎ খেলার উত্তেজনায় মনে হওয়া।
তবুও কিছুতেই আর সহজ হতে পারছে না মা। সেটা দেখেই ঐশীরও সুর কেটে গেছে খেলায়।
মায়ের চোখে হঠাৎ একটা অপরিচিত নামের স্মৃতি যেন মুহূর্তেই ছায়া ফেলে মিলিয়ে গেল। আসলে ঐশী মাকে আরও আরও পেতে চায়। মা ওর সব কিছুই নির্দিষ্ট সময়ে করে দেয়। বাবার সব কিছু নিখুঁত ভাবে করে রাখে মা। তবুও যেন মা সংসার থেকে বহুদূরে। মনের মাঝে কোনো এক জগৎ তৈরি করে রেখেছে মা। যেটা ঐশীর অজানা অচেনা, ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এই যে ওরা তিনদিনের জন্য দিঘা এসেছে, মা কিন্তু সেই নিরুত্তাপ। মুখে কষ্টকৃত হাসি।
রাজ তখনও বলে যাচ্ছে এই ঐশী বল না,গ দিয়ে ফলের নাম কি হবে?
আচমকা উঠে পড়েছে ঐশী। ধুর বোরিং খেলা।
চলো সমুদ্রের ধারে মসলামুড়ি খাবো।
ফিরে গিয়েই আবার সেই কলকাতার এক ঘেয়ে জীবন। স্কুলের নিয়মিত ক্লাস।
সমুদ্রের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে শোভনা। কি অদ্ভুত ঢেউ গুলো। বিরামবিহীন...ক্লান্তিহীন।
ক্লান্তিহীন? সত্যিই কি ওরা ক্লান্ত হয়না..নাকি , অবসর নেওয়ার সময়ই পায়না,অভিনয়ের নাট্যমঞ্চ থেকে। হয়তো শোভনার মতোই ওদেরও মনে হয় এবার বিরতি নিই,তারপরেই সিদ্ধান্ত বদল হয়। যদি ধরা পড়ে যাবে বলে আবার নতুন করে শুরু করে অভিনয় জীবন।
রাজ বললো, ঐশীর এবারের জন্মদিনটা বেশ বড় করে সেলিব্রেট করতে হবে। আর হাতে মাত্র একমাস। দাদাভাইএর কথায় ঐশী বললো,এবারের বার্থ ডে তে তোর গানের পুরো টিমকে নিয়ে আসবি। দিয়ে ফাটিয়ে গান চলবে।
রাজ বললো,গুড আইডিয়া।
রমানাথ গম্ভীর স্বরে বললো,তোমাদের গান মানে তো মাথা ঝাঁকানো, আর উল্টোপাল্টা শব্দ প্রয়োগ।
রাজ মেসোর কথার প্রতিবাদ করে বললো, আর তোমার গান মানে তো ওই একই খেয়াল ঠুংরি। কথা বিহীন গানে অভিব্যক্তি কোথায়, গায়কের মনের আবেগ কোথায়? শুধু কিছু যন্ত্রের শব্দের আনাগোনা।
মাসিমনি ওদের থামিয়ে বললো, আহা তোমরা চুপ করতো। ঐশীর বার্থডে প্ল্যানটা ওকেই ঠিক করতে দাও। বাবার ওই একটানা অন্ধকার ঘরে ক্যাসেটের তানপুরার দুঃখী সুরটা শুনতে ঐশীরও ভালো লাগে না। ঐশী বললো,দাদাভাইএর ব্যান্ডের গান হবে।
রমানাথের মুখে গোঁফের ফাঁকে মুচকি হাসি। সেটা তো আমিও জানি রে ঐশী তোর দাদাই জিতবে।
মেসো নড়ে চড়ে বললো,ধুর ধুর খালি পেটে গান হবে নাকি ছুটকির জন্মদিনে! খাওয়ার মেনুটা কি হবে সেটা নিয়ে কেউ কথাই বলছি না। মাসিমনি পেটে হাত বুলিয়ে বললো,আহা রে পেটুকরাম। ওটাই তো আসল।
মা আচমকা দূরের কোনো গ্রহ থেকে অন্যমনস্ক হয়ে বলে বসলো, ইলিশ পাওয়া যায় এখন? তাহলে সর্ষে ইলিশ করলেও হয়।
চমকে উঠেছে ঐশী। মা আর ইলিশ!মায়ের নাকি ইলিশ মাছে মারাত্মক এলার্জি। তাই ওদের বাড়িতে ইলিশ মাছটা ঢোকেই কম। যদিও ঐশী খুবই পছন্দ করে। কিন্তু মায়ের যেন ইলিশ রাঁধতে হলেই গায়ে জ্বর। গজগজ করে বলে, লোকে এই আঁশটে গন্ধের মাছ খায় কি করে! সেই ইলিশ মেনুতে রাখতে চাইছে মা। ঐশী যেন দিঘায় এসে মাকে নতুন করে চিনেছে।
যেমন ,মায়ের নাকি সব থেকে প্রিয় বেড়াতে যাওয়ার জায়গা সমুদ্র। অথচ সেই সমুদ্রের দিকে তেমন কোনো আগ্রহই নেই মায়ের। বাবার কাজ আর ঐশীর পড়ার চাপে ওদের সেভাবে বেড়াতে যাওয়াই হয়ে ওঠেনা। দিল্লি আর রাজস্থান ছাড়া কিছুই ঘোরে নি ওরা।
এবারে দিঘা আসার আগে বাবার প্ল্যান ছিল দার্জিলিং,মাসিমনিও দার্জিলিংয়েই ঘেঁসেছিলো।হঠাৎ মা বলে বসলো,মায়ের নাকি পাহাড় বড় অপছন্দের। তাই অবশেষে দিঘা।এখানেও মায়ের মুখে হাসি নেই দেখে ঐশীর কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে। কেন মা মাসিমনির মত আনন্দ করতে শেখেনি কে জানে!
তবুও মায়ের মুখটা বড় মায়াবী। কেমন যেন কষ্ট মাখানো। তাই ঐশী চায় সব সময় মাকে খুশি করতে। মায়ের পছন্দ অপছন্দ কোনোদিনই মা মুখ ফুটে বলে না। ঐশী চেষ্টা করে খুঁজে বের করতে। মায়ের প্রতি বাবার এই নির্লিপ্ততা দেখে মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে ওর।
মা যেন দূরের কোনো অজানা নক্ষত্র। যার নিজস্ব আলো হয়তো আছে কিন্তু বিন্দুমাত্র প্রকাশ নেই নিজেকে জানানোর।
হঠাৎ হঠাৎ ঐশীর ইচ্ছে করে মাকে জড়িয়ে ধরে খুব খুব আদর করতে। কিন্তু মায়ের ওই ঠান্ডা ব্যবহারটাই যেন অনেকটা দূরে পাঠিয়ে দেয় ওকে। আমার জন্মদিনে অবশ্যই সর্ষে ইলিশ হবে। বলে উঠলো ঐশী। সাথে মায়ের ফেভারিট চকলেট আইসক্রিম।
ঐশীরা দিঘা থেকে ফিরে এসেছে দিন পনেরো হলো। ওর জন্মদিনের কিছু না কিছু প্ল্যানিং চলছে রোজই বাড়িতে। সতেরো চলে যাওয়া আর আঠারো আসার সন্ধিক্ষণে একটা দিন। যেদিন নাকি ও এসেছিল এই পৃথিবীর মাটিতে। তাই সেটা সকলের কাছে খুব স্পেশাল দিন। মাসিমনি বলেছে বার্থডে ড্রেসটা গিফ্ট করবে। একটা রেড গাউন। ঐশীর স্কুলের সব বান্ধবীদের নিমন্ত্রন করেছে ও। ভিডিও ক্যামেরা, স্টিল ফটো সব কিছুর ব্যবস্থা হচ্ছে। ছবিটাই তো আসল। স্মৃতি ধরে রাখতে এর বিকল্প কিছুই নেই।
দিনটা তো ফুরিয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু ছবিগুলো দিনটাকে রঙিন করে রাখবে।
ঐশী বললো,দাদাভাই সব দায়িত্ব নিয়েছে যখন তখন সব পারফেক্ট হবে। রাজ বোনের পিঠ চাপড়ে বললো, আমাদের বন্য ব্যান্ড তো আছেই গানে। আর আরেকজন তুখোড় ফটোগ্রাফার বলেছি যে তোর মিষ্টি মোমেন্টগুলো ক্যামেরাবন্দী করবে।
মা বললো,কেন আমাদের বিশু দা তো ভালোই ছবি তোলে রাজ। আবার নিউটাউনের ফটোগ্রাফারের কি দরকার ছিল।অকারণে বিশু দা শুনলে কষ্ট পাবে।
রাজ ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললো, শোনো মাসিমনি ছবি যে কেবল পটে আঁকা নিশ্চুপ নয় এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন ইনি। হ্যাঁ চার্জ হয়তো একটু বেশি,কিন্তু আমার চোখে ইনি বেস্ট।
রাজের মাথায় হাত বুলিয়ে শোভনা বললো, তোরা খুশি হলেই আমরা খুশি।
জন্মদিনের দিন সন্ধ্যেতে ঐশীকে রেড গাউনে ঠিক যেন জলপরী লাগছিলো। মা এসে আদর করে নজর না লাগে যেন তাই আঙুল কামড়ে দিলো। ঐশীর বন্ধুরা এসে যাবে।
মা আজ একটা জলপাই রঙের জামদানি পরেছে। অদ্ভুত একটা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে মায়ের মুখে।
রাজ এসেই বললো, ঐশী ..পোজ দে ..ওই দেখ কাকু ক্যামেরা নিয়ে রেডি।খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা এক মুখ দাড়ি ,উস্কো চুলের বছর একজন বছর চল্লিশ বিয়াল্লিশের ভদ্রলোক হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
বারবার ঝলকে উঠছে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। মুহূর্তদের পালানোর পথ নেই। ঐশী খেয়াল করলো ফটোগ্রাফারের চোখ দুটো যেন ওর মুখে নেই।চোখদুটো বারবার মাকে দেখে চলছে।মায়ের মুখেও সেই উৎফুল্ল ভাবটা চলে গিয়ে মেঘলা আকাশের রূপ নিয়েছে।
বুফের দিকে দাঁড়িয়ে মা খুব আলতো গলায় বলল, কেমন আছো ঐক্যতান?
আজ কি তোমার শখের ছবি তোলা পেশায় পরিণত হয়েছে?
গোঁফের মধ্যে মৃদু ক্লান্ত হাসি হেসে ভদ্রলোক বললেন, পেটের দায়ে শোভনা।
শোভনা দীর্ঘশ্বাসটা গোপন না করেই বললো, সম্পর্কের থেকেও যে পেটের দায় বড় ঐক্য।তাই হয়তো সে জিততে পারলো। আর নির্জীব সম্পর্কের জ্বালা দেওয়ার ক্ষমতাই বা কতটা!
আজও ক্ষমা করো নি আমায়!
সর্ষে ইলিশ আছে মেনুতে, তোমার পছন্দএর খেয়ে যেও।
ঐক্য বলে উঠলো, শুধু কি আমার পছন্দের? তুমিও তো এক সময় ইলিশ পেলে আর কিছুই চাইতে না! তবে চকলেট আইসক্রিম তো তুমি মোটে ছুঁতে না ওটা বুঝি তোমার মেয়ের পছন্দের?
কথার উত্তর না দিয়েই এড়িয়ে এলো শোভনা।
ওদের সব কিছু লক্ষ্য করলো আরেকজন মানুষ সেটা হয়তো ওরা নিজেরাও জানলো না।
কে এই ঐক্যতান !ওই জন্যই সেদিন মা দিঘার ওই নামটাই হঠাৎ বলে ফেলেছিল।
মা এর ইলিশ পছন্দ ছিল? তাহলে মা খায় না কেন?
চকলেট আইসক্রিম মায়ের পছন্দ নয়,তাহলে মা কি জোর করে খায়?এত এত প্রশ্নের উত্তর কে দেবে ঐশীকে? মনের মধ্যে তোলপাড় করছে ওর।
দাদাভাইএর গানের ব্যান্ড এসেছে। সকলে ভীষন আনন্দ করে চলেছে। একমাত্র ঐশীই যেন এলোমেলো। শোভনা মেয়ের কাছে গিয়ে বলল,তোর কি কিছু হয়েছে?
ও কোনোমতে সামলে নিয়েছে গলার কাছে জমে থাকা প্রশ্নের ঝুলিকে। না মাকে কিছু বলা যাবে না।
উল্টে বললো,মা চলো ..তুমি আর আমি কয়েকটা ছবি তুলি। মা যেন কিছুটা আতঁকে উঠেই বললো,তুই কি খেপেছিস! এই বয়েসে আর ছবি তোলে না। ঐশীর জোরাজুরিতে যদি বা ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালো শোভনা কিন্তু কিছুতেই মুখ তুলে তাকাচ্ছে না ও।
ফটোগ্রাফার বললেন, জলপাই রঙে একটা বুনো বুনো গন্ধ আছে। জানো ঐশী, আমাদের কলেজের সব থেকে হৈচৈ করা মেয়েটার পছন্দের রং ছিল জলপাই।
মায়ের চোখ দুটো একটু ছলছলে। তাই নিয়েই মুখ তুলে তাকিয়েছে মা।
ফটোগ্রাফারের মুখে এক অদ্ভুত মুগ্ধতা। এর কারণ যে ঐশী নিজে নয় সেটা ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।
জন্মদিনের পর থেকেই ঐশীর নিজের মতামত না জানানো প্রায় নিশ্চুপ মা যেন আরো নিশ্চুপ হয়ে গেছে। কারণটা যে ঐক্যতান নামের মাঝবয়সী ফটোগ্রাফার সেটা আর কেউ বুঝুক না বুঝুক ঐশী জানে।
দাদাভাই...ওনার স্টুডিও নিউটাউনের কোথায় রে?
এড্রেসটা ঠিক করে বল।
ঐক্যতান তখন সবে স্টুডিও খুলে কম্পিউটাররের স্ক্রিনগুলো হালকা কাপড়ের টুকরো দিয়ে মুছে চলেছে।
সামনেই ঐশীকে দেখে কিছুটা চমকেছে ভদ্রলোক। সেটা ঐশীর চোখ এড়ায় নি।
সামলে নিয়ে বললেন, আরে তুমি? আমি তো তোমার দাদাকে দিয়ে ছবি পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমরা পাওনি এখনো?
একটু যে নার্ভাস লাগছে না ঐশীর তা নয়। সম্পুর্ন অপরিচিত একজন মাঝবয়সী লোকের সামনে এসে নিজের মায়ের অতীত জিজ্ঞেস করাটা মোটেই সমীচীন নয়। কিন্তু ঐশী অপারক। ওর মনের মধ্যে অনবরত ঘুরে চলা প্রশ্নগুলোর উত্তর না পেলে ও কিছুতেই মাকে আগের মত জড়িয়ে ধরতে পারছে না। কেমন যেন অচেনা লাগছে ওর মাকে।
একটু আমতা করে ঐশী বলেই ফেললো,আমার একটু ব্যক্তিগত প্রশ্ন আছে আপনার কাছে। আপনার কি সময় হবে এখন?
এমনিতেই টিউশন অফ করে এসেছে ঐশী। এখন যদি ভদ্রলোক বলে দেন এখন হবে না, তাহলে আবার কবে আসতে পারবে কে জানে?
ঐক্যতান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ঐশীর দিকে। সেই কলেজের শোভনা। চোখদুটো যেন অনবরত কথা বলে চলছে!
ছটফটে প্রাণচঞ্চল শোভনা!
মা, মা ছটফটে ছিল আঙ্কেল?
প্লিজ বলুন। আমি জানতে চাই কেন মা এত কম কথা বলে এখন?
নিজের এলোমেলো চুলের ভিতর আঙুল চালিয়ে ঐক্যতান বললো, শোভনা আর কম কথা? উফ ওর বকবকানিতে গোটা ক্লাসের সকলে ব্যতিব্যস্ত ছিল। হঠাৎ সকলকে নিয়ে শুরু করতো বেঞ্চ বাজিয়ে গান। সেকি আনতাবরি চিৎকার চলতো ক্লাস জুড়ে। শোভনার কোনো জড়তা ছিল না কারোর বিষয়ে। একমাত্র ঐক্যতান নামটা শুনেই একদিন সামনে এসে বলেছিল, এত সুন্দর নাম তোমার,আর স্বভাবটা এত খারাপ কেন?
আমার দিকে অমন চোখে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা করেনা।
আমি হেসে বলেছিলাম,এই প্রথম শুনলাম কোনো ফুল পথিককে বলছে,তাকাও কেন আমার দিকে?
লজ্জা পেয়েছিল শোভনা। সেই শুরু আমাদের বন্ধুত্বের। তখন আমার ছোট্ট শখের ক্যামেরার একমাত্র মডেল শোভনা। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে ও বলতো,উফ আমি পোজ দিতে দিতে ক্লান্ত হই ঐক্য,তুমি এই একই মুখের ছবি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হও না?
আমি বলতাম, আমি চব্বিশ ঘন্টা কাটাতে পারবো তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে।
শোভনা বলতো,ছবি তোলাটা পেশা করে ফেল ঐক্য। আমরা একটা ছোট্ট ঘর বাঁধবো। দেখতে ছোট হলেও ঘরটা তাসের নয় মজবুত ইটের হবে। আর প্রতিটা ইট হবে ভালোবাসার তৈরি।
শোভনা ছিল মারাত্মক ইমোশনাল। অভিমানী ,একটুতেই ঠোঁট ফোলাতো। ওকে বোঝাতে পারতাম না,ওদের সাথে আমাদের অনেক তফাৎ।
ওরা উচ্চবিত্ত, আর আমরা ছিলাম একেবারেই নিম্নবিত্ত। ওসব বোঝার পাত্রী ছিল না ও। বলতো,আমি মডেল হবো,আর তুমি ছবি তুলবে..সেই ছবি বিক্রি করে আমরা সংসার চালাবো।
আমাদের শখের ক্যামেরার ওই কমা মানের ছবির যে কোনো বাজার দাম নেই সেটা মানতেই চাইতো না ও।
হেসে ফেলেছে ঐক্য আঙ্কেল। হঠাৎ যেন কিছু মনে পড়ে গেছে। আমরা একবার কলেজ থেকে পিকনিকে গিয়েছিলাম। সেখানে মটন না খেয়ে শোভনা পাঁচপিস ইলিশ খেয়েছিল। আমার আর ওর ভীষন পছন্দের মাছ ছিল ইলিশ। তারপর থেকে যত বার ওদের বাড়িতে ইলিশ হত,দুপিস লুকিয়ে ও টিফিনবক্সে করে নিয়ে আসত আমার জন্য। আমাকে সামনে বসিয়ে খাইয়ে ওর ভীষন আনন্দ হতো
আচ্ছা আঙ্কেল..মা চকলেট আইসক্রিম পছন্দ করে না?
না না,একেবারেই না..শোভনা তো চকলেটের গন্ধটাই সহ্য করতে পারে না।
আর মায়ের সমুদ্র প্রিয় না পাহাড়?
সমুদ্র তো আমার প্রিয় ছিল,তোমার মায়ের পাহাড়। ও বলতো পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে নাকি নতুন চমক।
ভিতরে কেমন একটা কষ্ট হচ্ছিল ঐশীর। ঐক্য আঙ্কেলের পছন্দ বলে মা ইলিশ ছেড়েছে,আর ঐশীর প্রিয় বলে মা অপছন্দের চকলেট খেয়েছে। মায়ের নিজস্ব ভালোলাগাগুলো কেন মা এভাবে জলাঞ্জলি দিলো কে জানে?
ঐক্য আঙ্কেল ভরাট গলায় বলল, কলেজ শেষে শোভনা এসেছিল এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যেতে। ওর দুচোখের জলে ধুয়ে গিয়েছিল আমার হাতের তালু।
বিয়ের দেখাশোনা চলছে ওর বাড়িতে। শোভনা আমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না পণ করেছিল।
আমাকে বলেছিল, কিছু একটা করতে। ও নিজেও টিউশনি করতে চেয়েছিল।
বলেছিল,ঐক্য শখে নয় সম্পর্কের খাতিরে ছবি তোলাকে পেশা করে নাও।
ভয় পেয়েছিলাম আমি। সংসার,দায়িত্ব,বাড়িতে অবিবাহিত বোন..
ফিরিয়ে দিয়েছিলাম আমি ওকে। বলতে বলতেই স্টুডিওর পিছনের একটা ঘরে গিয়ে একটা অ্যালবাম নিয়ে এলো আঙ্কেল। পাতার পর পাতা মায়ের নানা মুখের ছবি। প্রতিটা ছবিতে মা হাসছে। কোনটায় মায়ের চুলে কোনো নাম না জানা বুনো ফুল।
ওর বিয়ের কার্ডটা আমার ঘরে ছুঁড়ে দিয়ে শোভনা বলেছিল, বিয়েতে ছবি তুলতে এসো ঐক্যতান। আমি অন্যের হয়ে যাবো দেখতে এসো তুমি।আমার চোখ দুটো আজ থেকে অন্য কাউকে দেখবে,সেই মুহূর্তের আমাদের শুভদৃষ্টির ছবি তুলতে এসো তুমি ঐক্যতান। ওটাই শোভনার সাথে আমার শেষ দেখা।
আবার এত বছর পরে হঠাৎ দেখা হলো তোমার জন্মদিনে।
অনেক বদলেছে শোভনা। অনেক পাল্টে ফেলেছে নিজেকে। সেই উচ্ছল হাসিটাই তো নেই ওর মুখে।
ঐশী আচমকা বললো,আপনি বিয়ে করেন নি আঙ্কেল?
ঘাড় নেড়ে ঐক্যতান বললো, হয়ে উঠলো না যে। একজনের বিয়ের সময়টায় সানাইএর আওয়াজ থেকে দূরে থাকতে গিয়ে অপরাধীর মত মুখ লুকিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তাই প্রজাপতি রুষ্ট হয়ে আর আমার বিয়েই দিলেন না।
অ্যালবামটা আমি কি নেব আঙ্কেল?
চোখের জলটা হাতের পিছন দিয়ে মুছে নিয়ে ক্লান্ত হেসে আঙ্কেল বললো, নাও। এতে তো বহুবছর আগের ঐশীই আছে।
বেরিয়ে যাওয়ার আগে পিছন ফিরে ঐশী বললো, আমার ঐ দিয়ে নামটা কি আপনার সাথে মিলিয়ে?
ঐক্যতান চমকে বললো, সেটা তোমার মা বলতে পারবে। কেন সে এই অপারক অপরাধীকে আজও মনে রাখতে চেয়েছে।
ঐশীর আজ খুব কষ্ট হচ্ছে মায়ের কথা ভেবে। মা আর ঐক্য আঙ্কেলের ভালোবাসা সাফল্য পায়নি শুধু মাত্র অর্থনৈতিক কারণে। সেই থেকেই হয়তো মা নিজেকে বাবার মনের মত করে গড়ে তুলতে গিয়ে এতটা বদলে ফেলেছে নিজেকে। বাবার মতোই গম্ভীর,কোনো কিছুতেই উত্তেজনাহীন একটা মানুষ।
মা ,একটা কথা বলবো?
ঐক্যতান আঙ্কেল আজও বিয়ে করেনি জানো!
হয়তো তোমাকেই ভালোবাসে!
তুমি তো মাত্র চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। তুমি ইচ্ছে করলে যেতেই পারো আঙ্কেলের কাছে। আবার নতুন করে শুরু করতেই পারো কিন্তু!
কথা না বলে জোরে একটা থাপ্পড় মেরে বসলো মা ঐশীর গালে।
আজ আর মায়ের চড়ে লাগলো না ঐশীর। মায়ের এই গোপন কষ্টের কাছে এটা যেন কিছুই নয়।
ধীর গলায় মা বললো, তুমি অনেক ছোট ঐশী। সব কিছু বোঝনা। দায়িত্বহীন ভালোবাসা কখনো সংসার গড়ে না, বরং ভালোবাসাহীন কর্তব্যও একটা সংসারের ছাতা হতে পারে। যেমন ..তোমার বাবা।
আমি অন্য কাউকে ভালবাসি জেনেও আমার সাথেই কাটিয়ে দিলো এতগুলো বছর। শুধু তোমার আর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
ভবিষ্যতে কখনো ঐক্যতানের নাম করবে না এবাড়িতে।
আমি তোমার বাবাকে সম্মান করি,আমাদের সম্পর্ককেও সম্মান করি।
অ্যালবামটা মায়ের বিছানায় রেখে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ঐশী। শোভনার কাছে আজ এগুলো শুধুই ধূসর জলছবি মাত্র।
সত্যিই ও অনেক ছোট। ভাবাবেগে জীবন চলে না,এটুকু আজ বুঝলো ও।
খুব ইচ্ছে করছিল ওর গম্ভীর বাবাটাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে। বাবার ঘরে খেয়াল এর ক্যাসেট চলছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো ঐশী। পিছন থেকে বাবাকে জড়িয়ে ধরতেই ওর ভীষন গম্ভীর বাবাটাও যেন কেঁপে উঠলো। কিরে পাগলী, হঠাৎ বুঝি বাবার আদর খেতে ইচ্ছে হলো?
বাবার বুকে মুখগুজে অনেক্ষন আদর খাচ্ছে ঐশী। খেয়াল করেনি কখন মা এসে হাত বোলাচ্ছে ওর মাথায়। ঐশী ছোটহলেও এটুকু বুঝলো,ও নিজেই বাবা মায়ের সম্পর্কের সেতু।
এক চিলতে রোদ্দুর- কলমে-অর্পিতা সরকার
সমাপ্ত