বার্ধক্যের পরিণতি




গল্প

বার্ধক্যের পরিণতি


“ও খোকা ঠাণ্ডা পড়েছে গলায় মাফলারটা জড়িয়ে নিবি রাতে যখন আসবি”।
রাজু থমকে দাঁড়াল, চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে কাউকে না পেয়ে ভাবল মনের ভুল। তাড়াতাড়ি পা চলিয়ে দিল বাস স্টপেজের দিকে। অফিসে কাজে ব্যস্ত রাজু এমন সময় হঠাত একদম কানের পাশে কে যেন ফিসফিস করে বলে উঠল – টিফিনটা খেতে দেরি করিসনা খোকা।

চমকে চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখে আবার বসে পড়ল। বিরক্তি লাগল রাজুর নিজের ওপরে। আজ দুদিন সে মাঝে মাঝেই এইরকম ভাবে মা-র কথা শুনছে। অথচ মা মারা গিয়েছে ছমাস হয়ে গেল। এতোদিনতো কিছু হয়নি হঠাত করে পরশু থেকে এই কাণ্ড শুরু হয়েছে। বাড়িতে খুব সাবধানে থাকছে যাতে তার কোনও আচরণে লেখার মনে কোনও সন্দেহ না হয়।
অফিস থেকে একটু জলদিই আজ ফিরেছে রাজু কারণ সে একলা ঘরে একটু পুরো জিনিষটা চিন্তা করতে চায়। লেখা দুদিনের জন্য বাপের বাড়ি গিয়েছে। এক কাপ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসল। কফি শেষ করে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে হয়রানির একশেষ। লাইটার দেশলাই সব হেরে গেল কিন্তু কিছুতেই সিগারেট জ্বালাতে পারলনা। এইবার রাজুর একটু ভয় করতে লাগল। হাত পা কাঁপতে লাগল। দৌড়ে গিয়ে বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দিল। আবার সেই স্বর!




--“ভয় পেলি খোকা ? দরজা বন্ধ করে কি আর আমায় আটকাতে পারবি বাবা ? এখন বড় হয়ে তুই আমার থেকে দুরে পালাচ্ছিস কিন্তু ছোটো বেলায় এক দণ্ডের জন্যও ছাড়তিসনা আমায়। ভয় পাসনা, আমি যে তোকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি। আমি শুধু জানতে চাই তুই আমকে মারলি কেন ? বুড়ি হয়েছিলাম এইটাই আমার দোষ! আমি তোদের সংসারে আর আগের মতো খাটতে পারতামনা তাই! আমার জন্য তোদের খরচা হতো তাই! কিন্তু আমার খরচা তো তোর বাবা যে টাকা রেখে গিয়েছে তাই থেকেই হতো। মরবার পর টাকাটা তো তোর নামেই হতো।
জানিস খোকা আমি এখন সব বুঝতে পারি কিন্তু বলবনা, তোর মুখ থেকেই শুনতে চাই। সোজা কথায় যদি না বলিস তাহলে কিন্তু আমাকে একটু বেঁকে দাঁড়াতে হবে”।



রাজুর মনে হল এতক্ষণ মার যে গলার আওয়াজটা শুনছিল তা যেন একটু পাল্টে গেল। সেই নরম ভাবটা আর নেই। উপায় নেই দেখে অসহায় রাজু বলতে শুরু করল ----
----“তুমি তো জানো মা লেখাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। হয়তো এই বিয়েটাই আমার জীবনের সব থেকে ভুল। বড়লোকের স্বেচ্ছাচারী মেয়ে নিজেকে ছাড়া কাউকেই হয়তো ভালোবাসতে পারেনা। তুমি হয়তো বুঝেছিলে তাই বিয়েতে বারণ করেছিলে। কিন্তু আমিতো পাগল ছিলাম লেখার জন্য। তাই তোমার কথা শুনিনি তখন। তার সব কথাতেই রাজি হয়ে বিয়ে করেছিলাম। প্রথমে তো সব ঠিক চলছিল কারণ সংসারের সব কাজই তুমি সামলাতে। ঝামেলা হল যখন তুমি অসুখে পড়লে। সংসার সামলাতে গিয়ে লেখার বাইরের জীবনে ব্যাঘাত ঘটতে লাগল। রোজ অফিসের চাপ সামলে ঘরে এসে শুনতে হতো নানান অভিযোগ। লেখা রান্নাও ঠিক মতন সবদিন করতনা। বললে বলত সারাদিন সে রুগীর সেবা করে ক্লান্ত। এই ভাবে অশান্তি যখন চরমে তখনি তুমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি হলে। টাকা ও পরিশ্রম দুটোতেই লেখার শেষ ধৈর্যটুকুও চলে গেল। ও আমাকে বোঝাল তোমার বয়স হয়েছে কতদিন বা আর বাঁচবে। তুমি মারা গেলে বাবার টাকা আমি পাব আর সেই টাকা দিয়ে আমরা ফ্ল্যাটের লোণ অনেকটাই শোধ করতে পারব” এই পর্যন্ত বলেই রাজু মুখে হাত চাপা দিয়ে কেঁদে উঠল। বারবার বলতে লাগল, “আমি অন্যায় করেছি, আমি অন্যায় করেছি”।




চারিদিক মৃত্যু পুরির মতোই শান্ত আর নিস্তব্ধ। একসময় সেই স্বর ভেসে উঠল, তারপর-------
---“লেখাই সুযোগ মতো অক্সিজেন বন্ধ করে দিয়েছিল”।
----“লেখা তো পরের মেয়ে কিন্তু আমি আশ্চর্য হচ্ছি তুই কিভাবে সাথ দিলি, তোর তো মা আমি। আমি তোর কত অত্যাচার সহ্য করছি। কত রাত জেগেছি তোর অসুখে। কতদিন দুপুরের খাওয়া খেতে পাইনি। আজ বয়সের ভারে আমি পারিনি তোদের সংসারের কাজ করতে তাই তুই মেরে ফেললি আমায়! বার্ধক্য তোর জীবনেও আসবে খোকা, তখন তোকেও যদি তোর খোকা মেরে ফেলে! বুড়ো হলে তুই ও তো আর উপায় করতে পারবিনা, কি হবে”?
উত্তাল হাসির ঢেউ ঘরের চারদিকে ঘুরতে লাগল।

সমাপ্ত
--------------------
ভাষাপথ অ্যাপটি ব্যবহার করবার জন্য ধন্যবাদ। এই অ্যাপটি ভালো লাগেল, অবশ্যই ফাইব ষ্টার রেট দেবেন এবং কমেন্ট করে আপনাদের মতামত জানাবেন এবং সকলের সাথে শেয়ার করে নেবেন।