গিরিরাজের ডাকে সান্দাকফুতে ....✍প্রাণকৃষ্ণ মিশ্র
ভ্রমণ
গিরিরাজের ডাকে সান্দাকফুতে
প্রাণকৃৃষ্ণ মিশ্র

এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে সকলকেই একদিন চলে যেতে হবে। চির সত্য। তবুও ভাবি এই আকাশ, বাতাস, পাহাড় বারেবারে কেন আমায় ডাকে ? কেন আমায় প্রেমে আবদ্ধ করে গিরিরাজ ? শুধু আমাকেই না আমার বেশ কয়েকজন বন্ধুরও একই পরিস্থিতি। আমি এইসব বন্ধুদের হয়তো যোগ্য নই, তবুও আমায় ভালোবাসে বন্ধুরা ও গিরিরাজ হিমালয়। উত্তর পাই নি এই প্রশ্নের, আমি শুধুই ভাবি আর ভাবি। তাই ওদের মাঝে মিশে গিয়ে উপলব্ধি করতে চাই আমার আমিত্বকে।
আবার ডাক, এবার হিমালয়ের সান্দাকফু যাবার। এইবার ট্রেকিং এর ডাক পেলাম অনির্বানের থেকে। আগেও আমি ট্রেকিং করেছি অনির্বানের সঙ্গে, সঙ্গে ছিল আমার প্রিয়জন সোমনাথ দা ও রাজীব। এবার সোমনাথদার ভয়েস বার্তা এলো আরো দুজনকে সঙ্গে নিতে হবে। তাই আমি রানীগঞ্জের বিশ্বরূপকে রাজি করলাম আর অনির্বাণ রাজি করল বন্ধু বিপ্লববাবুকে । বলে রাখি এরা সকলেই বড্ড ব্যস্ত মানুষ,জমে উঠল আড্ডা হোয়াটস এপ গ্রূপে,সকলেই আমারা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম কয়েক মাসের মধ্যেই।
প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম এই ট্রেকিং এর ক্ষেত্রে,কারন যাবার দিন স্থির হলো ২১ শে,ডিসেম্বর ২০১৮। আগেই শুনেছিলাম এই সময় সান্দাকফুতে বরফপাত হয়। কনকনে ঠান্ডা সঙ্গে প্রচন্ড শীতল ঝড়ের তান্ডব চলে। একটু ভয় হয় আবার ভাবি, ভয়কে জয় না করতে পারলে বেঁচে থেকেই বা কি লাভ?এসেছি এই পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষের রূপ নিয়ে কিন্তু ভগবান আমার নাগালের মধ্যে যেটুকু সাজিয়ে রেখেছেন , তা না দেখেই কি ফিরে যাব মৃত্যুর কোলে? তাই মনে সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করি। মিশন সান্দাকফু ,বাংলার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয়ের ইচ্ছা মনেপ্রানে একাত্ম হয়ে ওঠে।

টানটান উত্তেজনা। যাবার ২ মাস আগে থেকেই একটু হাঁটাহাঁটি ,শারীরিক কসরৎ শুরু। অবশেষে ২১ শে ডিসেম্বর তিস্তাতোর্ষা এক্সপ্রেসে উঠে বসা। পরের দিন ভোর ৪ টায় পৌঁছালাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। একটা গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে পাহাড়ি ছোট্ট গ্রাম ধোত্রের উদ্দেশ্যে। চা বাগানের মধ্য দিয়ে গাড়ি ছুটতে ছুটতে ঘুম , মানেভঞ্জন পেরিয়ে সকাল ৮ টায় ধোত্রে পৌঁছালাম। হাতে খুব বেশি সময় নেই। এদিন ধোত্রেতে রাত্রিবাস করলে ভালো হতো। কারন শরীর সকলেরই ক্লান্ত। কিন্তু আমাদের হাতে সময় কম। তাই একটু টিফিন করেই সকাল ১০ টায় আমরা ট্রেকিং শুরু করলাম টংলুর উদ্দেশ্যে। টংলুর উচ্চতা ১০,১৩০ ফুট। ধোত্রের উচ্চতা ৮৫০০ ফুট, তাই প্রথম দিনই খুব চাপের। কিন্তু হিমালয়ের অসীম সৌন্দর্য সব পর্বত প্রেমীককেই পাগল করে তোলে । কোন বাধাই বাধা লাগে না। রডোডেনড্রেন আর পাইনের ছায়ায় হেঁটে চলেছি আমরা মায়াবী পথ ধরে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের প্রত্যেককে আপন করে নিয়েছে হিমালয়। বিশ্বরূপ বলে ওকি দাদা “ওটা কি আসছে”? একটু হাসলাম, ওকে বললাম ওটা কিছু না, পাহাড়িয়া মেয়েরা উপর থেকে গবাদি পশুর খাবারের জন্য ও জ্বালানির জন্য ঘাস কেটে ফিরছে ঘরে । সেই ঘাসেই ওদের মুখ ঢেকে আছে, তাই এমন মনে হচ্ছে। সে যেন এক চলন্ত বন। ওরা খুব পরিশ্রমী ,কষ্ট সহিষ্ণু। কিছুটা এগিয়ে চলতে চলতেই চোখে পড়ল কিছু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম। ওরা পুকুর খনন করছে। এই গভীর জঙ্গলে কি হবে পুকুর কেটে? এরা কি এখানে মাছ চাষ করবে ? আমাদের গাইড রাজুকে জিজ্ঞাস করলাম এরা কি করছে, কেনই বা মাটি কাটছে? রাজু উত্তর দিল পাহাড়ি জন্তুদের তৃষ্ণা নিবারনের জন্য এমন পুকুর খনন।এই জঙ্গলে লেপার্ড, লেপার্ড ক্যাট, রেড পান্ডা, ভল্লুক,বন মুরগি সহ বিভিন্ন পাখির বাসভূমি। পুকুর কেন কাটছে শুনে ভালো লাগলো। কারন আমরা সমতলের মানুষ পুকুর বুজিয়ে ফেলি অর্থ ললুপতার কারনে , আর পাহাড়ের মানুষ কত সচেতন। অনির্বান ডাক দিল আমাদের।

চলো -চরৈবতে বেশি দেরি করলে টিম স্পিরিট হারিয়ে যাবে ,তাছাড়া অনেকটা পথ চলতে হবে। চারিদিকে গাছগাছালির পাতা ঝড়ার শব্দ। একটু দ্রুত হেঁটে অনেকটা উপরে এক প্রশস্ত সমতল ভূমি। একজন সহযাত্রী বন্ধু প্রকৃতির ডাকে এখানেই সাড়া দিলেন। হালকা বরফ ঘাসের উপর। এই প্রথম বরফ দর্শন এই পথে। আরো কিছুটা চড়াই পেরিয়ে পৌঁছালাম টংলু। অনেকেই টংলুতে রাত্রিবাস করেন। খুব সুন্দর জায়গা। কিন্তু আমরা এখানে হোমস্টে না করে হালকা টিফিন ও চা খেয়ে আরো তিন কিমি দূরে টুমলিং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। টংলু থেকে ঘুমন্ত বুদ্ধ অর্থাৎ কাঁঞ্চনজঙ্গা ও মাউন্ট প্যান্ডিম সহ অন্যান্য শৃঙ্গগুলি ভালো দেখা যায়। কিন্তু মেঘের ঘোমটা টেনে বসেছিল সেইদিন । তাই ভালো দেখা গেল না। টুমলিং এ আগে থেকেই আমাদের ঘর বুকিং করা ছিল। তাছাড়া আমাদের টিম ম্যানেজার অনির্বাণের পছন্দের জায়গা এটি। বিকাল ৪ টে নাগাদ আমরা টুমলিং পৌঁছাই।ইতিমধ্যে মেঘ সরেছে। দেখা গেল কুম্ভকর্ণ কে বা স্লিপিং বুদ্ধকে। ক্লান্ত শরীর, তাই হোটেলের ঘরে যাই। চা, টিফিন করেই বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। সন্ধ্যায় কিছুটা খুশির মেজাজে এদিক ওদিক ঘুরে রাত্রি ৮ টার মধ্যেই শরীর সজ্জা নেয় বিছানায়।
বলে রাখি সান্দাকফু ট্রেকিং রুটে অনেক ট্রেকারই বাঁধানো পথে ট্রেকিং করেন। কিন্তু আমাদের টিম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেপালের পাহাড়ি পাথুরে আঁকাবাঁকা পথেই ট্রেক করেছি। এটিই আমাদের পছন্দের। পরের দিন ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠেই দেখি অনির্বান ও বিপ্লব নেই । কোথায় গেল ওরা? আসলে সেদিন আমার ভোর হয়েছিল সকাল ৬ টায়। আর ওদের ভোর হয়েছিল ৪.৩০ টায়। ওরা ক্যামেরায় সূর্যদয়ের ও বরফ পাতের ছবি তুলে এনেছে । এক মুখ তৃপ্তি ওদের চোখে মুখে। যা থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। যাই হোক দুঃখ করে লাভ নেই কারন আমি জানি হিমালয় কাউকে কখনো বঞ্চিত করেনা। আরো কিছু বিশেষ উপহারের ডালি সাজিয়ে হিমালয় এ যাত্রাতেও অবাক করবেই আমায়।
পরের দিন সকাল ৮টায় আবার পথচলা শুরু। আজ অনেকটা পথ হাঁটতে হবে আমাদের। টুমলিং থেকে কালিপোখরির দূরত্ব প্রায় ১৫ কিমি। আজ রাত্রিবাস কালিপোখরিতে(১০৪০০ফুট)। সিঙ্গালীলা ন্যাশনাল পার্কের অনুমতি নিয়ে ধীরে ধীরে পথচলছি। এই পথ আরো বেশি চড়াই উৎরাই ও বিপদ সঙ্কুল।অনেকটা দূরে দূরে কয়েকটি বাড়ি। পাহাড়ি গ্রাম এমনই হয়। এমনি একটি গ্রামে পথ ভুল হওয়ায় এক বৃদ্ধ দেখালেন সঠিক পথ। নেপালের গিরিবাস হয়ে আমাদের পথচলতে হবে। সে পথে হাঁটতে হাঁটতেই শুনলাম গিরিবাসে পৌঁছে আমরা টিফিন করব। টুমলিং এর পর কিছুটা চড়াই পেরিয়ে গিরিবাস পর্যন্ত বাকি রাস্তাটি উৎরাই।অপূর্ব সৌন্দর্য গিরিবাসের। চারিদিক সবুজ আর সবুজের আলিঙ্গন।
পথ চলতে কষ্ট হচ্ছে তবুও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারনে সে কষ্ট কেউই গায়ে মাখিনি। গিরিবাসে পৌঁছে বেশ কিছুটা পরিশ্রমের কারনে গায়ে কিছুটা ঘাম জমায় জ্যাকেট খুলে ফেলি। মিনিট পেরোয়নি, দেখি শীতে কাঁপছি। অনির্বান নির্দেশ দিল গরম করলেও জ্যাকেট খুললে চলবে না। ম্যানেজারের নির্দেশ মত আবার জ্যাকেট গায়ে জড়ানো। ট্রেকিং এর সময় কোন একজনকে নেতা মেনে চলা উচিত। সে শৃঙ্খলা না মানলে ভীষন অসুবিধা।
একটি দোকানে চা ও বিস্কুট খেয়ে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলা। বাকি রাস্তা এর পর বেশ জটিল ও পুরোটাই চড়াই। রাস্তা এবারো খেবরো, পথ পিচ্ছিল ও শক্ত বরফে ঢাকা। কোথাও আবার বরফ গলে গিয়ে কাদা হয়ে গেছে। চড়াই বাড়ছে, হাঁফ আসছে। অক্সিজেন বড্ড কম ,সাথে সাথে শীতল বাতাসের তান্ডব। তৃষ্ণা বাড়ছে গলা শুকিয়ে কাঠ,এদিকে আমাদের কারুর কাছেই জল অবশিষ্ট নেই। কিছু দূর গিয়ে অন্য একটি গ্রূপের একজনের দেখা পাওয়া গেল।ওরা পথচলতে চলতে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল। ওনার কাছ থেকেই একটু জল খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলাম। গন্তব্য যখন সকলের একই, তখন সকলেই সকলের বন্ধু। কে কোন জাত, কোন রাজ্যের বা রাষ্ট্রের বাসিন্দা এ প্রশ্ন আসে না কারুরই। এ শিক্ষা সব পথিকেরই আছে। স্বার্থপরতা শূন্য অবস্থান সকলের। তৃষ্ণা মিটে যাবার কিছুক্ষন পরই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার ইচ্ছা। কিন্তু না। এই সময় প্রস্বাব করলে শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যাবে অন্তত দুই ডিগ্রি। পাখিরা গাছের এ ডাল ও ডাল করছে আর মিষ্টি সুরে গান গাইছে।ওদের এই আনাগোনা পাহাড়ি পথে আলাদা রূপ দিয়েছে।
আমাদের এগিয়ে চলা এই পাইনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই। কিছুক্ষণ পর পরই সুখী ভ্রমনার্থীদের নিয়ে ল্যান্ড রোভারের আনাগোনা। ট্রেকিং রুটে এটি বড্ড বেমানান। তবুও বলি এই পথে কোন ভ্রমন পিপাসু ব্যক্তিকেই দৃষ্টি সুখ থেকে সিঙ্গলীলা বনাঞ্চল বঞ্চিত করে না। ট্রেকিং রুট ও মটর গাড়ির রুট মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে। বিভিন্ন নাম না জানা পাখিদের মধ্যে অনির্বাণের ক্যামেরায় ধরা পড়ে গেল ব্লু ম্যাগপাই সহ টুনটুনির মত কয়েকটি সুন্দর পাখি। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতেই একটি হোম স্টে দেখতে পাই। এখানেই চা খেয়ে লাঞ্চ করার জন্য অনুরোধ জানাই গৃহকর্ত্রীকে। উনি বললেন শুধুই চাউমিন পাওয়া যাবে। তাতেই রাজি আমরা। চাউমিন খেয়ে আবার পথচলা রডোডেনড্রন আর পাইনের জঙ্গল দিয়ে বরফে পিচ্ছিল পাথুরে রাস্তা দিয়ে।
এবার হঠাৎই দেখা মিলল এক মস্ত বড় এক রেড পান্ডার। অপ্রস্তুত অবস্থায় আমাদের দেখেই ও হতভম্ব হয়ে যায়। এদিকে আমাদের ক্যামেরা সেই সময় তৈরি না থাকায় আমরা বেশ কিছুক্ষণ কাছ থেকে ওকে পেয়েও ছবি তুলতে পারলাম না। সবাই চুপচাপ। রেড পান্ডাটি ততক্ষনে জঙ্গলের একটি গাছের মগডালে । বেশ কিছুক্ষন সময় দিল আমাদের ছবি তোলার জন্য। আমাদের খুশি করে ওরও ভীষন মজা হলো বোধহয়। তারপর হারিয়ে গেল গভীর থেকে আরও গভীর জঙ্গলে। এই সিঙ্গলীলা ট্রেকে এটি আমাদের বড় পাওনা। আবার হাঁটা শুরু। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা ৫টায় আমরা
কালিপোখরি লেকের কাছে পৌঁছালাম। কালি মানে “কালো”, পোখরি মানে “ পুকুর”। অর্থাৎ যে পুকুরের জল কালো। এই লেক নিয়ে অনেক রূপকথার গল্প শোনা যায়। শোনা যায় রাতের অন্ধকারে অশরীরী আত্মারও দেখা মেলে। জলের মধ্যে সারা রাত্রি নাকি কেউ পাথর ফেলে। আরো একটু উঠে আমাদের হোম স্টে “প্যান্ডিম হাউস”। ক্লান্ত শরীর। ভয়ঙ্কর ঠান্ডা। শীতে কাঁপছি । হোমস্টেতে ঢুকে এককাপ চা খেয়ে পথের স্মৃতিচারণ করতে করতে ডাক পড়ল রাত্রির খাবারের জন্য। খাবার খেয়ে কখন যে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়েছি সেদিন,তা আমি জানি না।
পরের দিন ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেই দেখি হোম স্টের সামনে বরফ জমে। চারিদিকের ছোট বড় পাহাড় গুলি সব বরফের চাদরে ঢাকা। কিছুক্ষন পরই সুর্য মামার দেখা। ঝিকিমিকি আলোয় ঘুম ভেঙেছে পাইনেরও। কালিপোখরি নেপালের সীমান্ত গ্রাম। ভারতীয় ফৌজিরা রাত্রের ডিউটি সেরে ফিরে চলেছে নিজেদের ব্যারাকে। আর দেরি নয়। আমাদের ও হাঁটতে হবে সান্দাকফুর উদ্দেশ্যে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিয়ে আবারও পথচলা শুরু। পাহাড়ি কচিকাঁচা শিশুরা পথের ধারে খেলায় মেতেছে। আজ ভীষন শীত,ঠান্ডা ঝোড়ো বাতাস বইছে। গাইড রাজু বলল আজ ভয়ঙ্কর চড়াই পেরুতে হবে আমাদের। অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে বিশেষ কয়েকটি জায়গায়। হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়ল পাহাড়ি শিকারী বাজপাখি ও দাঁড় কাকের। আমার মনে হলো যেন ,ওরা আমার মত শয়তানদের ঠিক মেনে নিতে পারছে না এই শান্তির হিমালয়ে। সত্যি তো সব জন্তুর থেকে স্বার্থপর আমরাই। এই পাহাড়টাও আমরা কেড়ে নিতে চাই ওদের থেকে। এটাকে বিক্রি করে অট্টালিকা বানাতে পারলেও যেন আমাদের মত শহুরে মানুষের শান্তি হবে মনে। যতটুকু দূষণ এই পাহাড়ে তাও আমাদেরই সৃষ্টি। ভাবতে ভাবতেই পথ চলছি।
আজ আমার কন্যার পঞ্চম শ্রেণীর ভর্তির জন্য তালিকা বের হবে। থাকবে তো ওর নাম? বিভিন্ন চিন্তা। আমি কত স্বার্থপর। এই গুরুত্বপূর্ণ দিনে ওর পাশে না থেকে আমি হিমালয়ের কোলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আসলে টিকিট অনেকদিন আগেই কাটা ছিল। আর তখন জানতাম না এই সময়েই সমতার পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি । আজ ভীষন কষ্ট হচ্ছে মনে। এদিকে গত দুই দিন দূরভাষে কোন যোগাযোগ করা যায়নি । পুরো রাস্তাটাই নেপাল-ভারত সীমান্ত। এগুতে এগুতেই বেশ কয়েকবার ঘুমন্ত বুদ্ধের দেখা মিলল। ছবি উঠছে বারেবারে বন্ধুদের ক্যামেরায়। এদিকে বিশ্বরূপ খুব হাঁফাচ্ছে ,একটু ভারী শরীর ওর । এটি ওর জীবনের প্রথম ট্রেকিং সেই কারণেই আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছে। একটি জায়গায় দুপুরের খাওয়া সেরে নিই হালকা করে। গাইড রাজুকে জিজ্ঞাসা করলাম আর কত দূর সান্দাকফু? রাজু হাত তুলে দেখেলো আর বেশি নেই । “ সাবজি উপর মে জো বিল্ডিং দেখা রহি হ্যায়, ও হি সান্দাকফু, স্রেফ দো কিমি বাকি “। কিন্তু আমাদের কাছে এটাই অনেক দূরে।
শর্টকার্ট রাস্তায় হাঁটা শুরু করলাম এবার। পেটে খিদে। পাকদন্ডী পথটুকু পেরিয়েই মাইলস্টোন চোখে পড়ল সান্ডাকফু “০কিমি”।
এদিকে প্রচন্ড গতিতে পাহাড়ি ঝড় বইছে। চারিদিকে বরফের চাদরে মোড়া। বেশ কয়েকটি গাছের পাতাতেও বরফের আলিঙ্গন। কিছুদূর যাবার পরই দেখি রাজুকে অপেক্ষা করতে। হোমস্টের মালিক বিশেষ আপ্যায়ন করে আমাদের ঘরে নিয়ে গেলেন। ওনার ঘরের সামনেও বরফ। কিছুক্ষন বিশ্রাম করে চা খেয়ে একটা ঘুম। দুপুরে ঘুম বাঙালির বেশ পছন্দের। রাজু বিকাল ৪ টের সময় ঘুম থেকে উঠলো। আরো একবার চা, বিস্কুট খেয়ে চললাম ভিউপয়েন্টে এক কিমি দূরে অত্যন্ত সাবধানে। কারন রাস্তায় বরফ খুব শক্ত ও পিচ্ছিল। সাথে প্রায় ১০০ কিমি বেগে ঝড়। এদিকে সূর্য রশ্মির খেলা শুরু হয়ে গেছে মাউন্ট প্যান্ডিমে তাঁর পর কাঁঞ্চনজঙ্গায়। ঘুমন্ত বুদ্ধ সাদা ভাব কাটিয়ে সোনালী চাদরে সেজে উঠল। বিশ্বকর্মা নয়, সুর্যদেবই এখানে শিল্পীর ভূমিকায়। ধীরে ধীরে সেই আলো পড়ল মাউন্ট লোডসে , মাকালু তারপর পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেষ্টের উপর। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। একসঙ্গে এতগুলি জানা অজানা বিশ্বশ্রেষ্ঠ শৃঙ্গ পৃথিবীর অন্য কোন জায়গা থেকে দেখা যায় না। সান্দাকফু গিরিরাজের সেই স্থান যেখান থেকে গিরিরাজ আমার মত অতি সাধারন ট্রেকারকে মুগ্ধ করে।
ইতিমধ্যে আমার সহযাত্রীরা সকলেই শীতল ঝড়ের কারনে ফিরে গেছে। অনির্বান আর আমি থেকে যাই আরো কিছু দেখার অপেক্ষায়। এরপর দেখা পাই মেঘ সমুদ্রের। ঝড়ের আওয়াজ সমুদ্র সৈকতের আওয়াজের তীব্রতাকে হার মানায় সেদিন।
এদিকে বন্ধুরা নিশ্চয় খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে, এটাই স্বাভাবিক। ফিরে আসি হোমস্টেতে। হুম সত্যিই ওরা আমাদের জন্য চিন্তা করছিল। সোমনাথ দা একটু বকাঝকাও করলেন। এরপর আত্মতৃপ্তি ও স্মৃতিচারণা। সন্ধ্যা ৮ টায় রাতের খাবার খেয়ে ঘুমের রাজ্যে বিচরণ। কিন্তু একি। ঘুম আসছে না। সদাই মনে হচ্ছে হোমস্টের দরজা জানালায় কে যেন কড়া নাড়ছে। খটখট খটখট আওয়াজ বারেবারে। দরজা খুলে বুঝি আসলে ভুতপ্রেত না, প্রচন্ড গতির ঝড়ই এমন আওয়াজের কারন। বাথরুমে গিয়ে দেখি সেই জলও বরফের আস্তরনে ঢাকা।
পরের দিন সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি সূর্যদয়ের সময়। উঠলে হয়ত নতুন কিছু দেখতে পেতাম।
আজ আমাদের যাওয়ার কথা রিম্বিক। কিন্তু এক বিশেষ কারনে আমরা সেই যাত্রা বাতিল করতে বাধ্য হই। সকলের যৌথ সিদ্ধান্তে ল্যান্ড রোভার ভাড়া করে ফিরে আসি মানেভঞ্জন। তারপর মানেভঞ্জন থেকে অন্য একটি গাড়িতে শিলিগুড়ি।
মনে দুঃখ যন্ত্রনা নিয়েই ফিরে আসলেও সান্দাকফু দেখা আমাদের তৃপ্ত করেছে প্রত্যেককেই। সান্দাকফু সত্যই বাংলার সুইজারল্যান্ড। বারেবারে এ পথ ডাকে ট্রেকার্সদের।
আগামী দিনে সান্দাকফু হয়ে ফালুটের স্বপ্ন মননে জড়িয়ে শুধুই স্বপ্নের জালবোনা চলবে আর ফিরে দেখা সান্দাকফুর স্মৃতির রোমন্থন।
(সমাপ্ত)
কিভাবে যাবেন :- হাওড়া থেকে ট্রেনে, বাসে বা প্লেনে শিলিগুড়ি বা বাগ ডোগড়া। এরপর ট্যাক্সী ভাড়া করে মানেভঞ্জন বা ধোত্রে ।
আনুমানিক খরচ :- জনপ্রতি ১০,০০০ টাকা।
--------------------