সাঁইসাধন তীর্থে কয়েক দিন ....✍প্রাণকৃষ্ণ মিশ্র
ভ্রমণ
সাঁইসাধন তীর্থে কয়েক দিন
প্রাণকৃৃষ্ণ মিশ্র

পৃথিবী জুড়ে খ্যাতি সত্য সাঁইবাবার। দেশের বিভিন্ন জায়গা ছাড়িয়েও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁর
অসংখ্য অনুগামী আছেন। সত্য সাঁই এর পিতার নাম পেডাভেঙ্কমা রাজু রত্নকারাম ও মায়ের নাম
ঈশ্বরামমা। এনার প্রধান ও প্রথম আশ্রমটি তাঁর নিজের গ্রাম পুত্তাপূর্তির প্রশান্তিনিলয়মে। চারিদিকে পাহাড় আর পাহাড়। দিগন্তবিস্তৃত নীল আকাশের নিচে পাহাড়ে ঘেরা এই জায়গাটি যেন সত্যই স্বর্গ। দেশ বিদেশের ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের কাছে আজ অতি পরিচিত জায়গা।
পূজার ছুটি কাটাতে আমাদের এবছর গন্তব্য ছিল পুত্তাপূর্তি। আগেই ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল । ফেরার টিকিট ও একই গাড়িতে।

হাওড়া থেকে একটিই ট্রেন(সত্য সাঁই প্রশান্তি নিলয়ম এক্সপ্রেস)প্রতি বুধবার দুপুর ৩.২০ মিনিটে ছাড়ে পাহাড় ঘেরা এই ছোট্ট গ্রামটির উদ্দেশ্যে। আমি এই ট্রেনেরই যাত্রী। প্রসঙ্গত বলে রাখি এই ট্রেনটি ছাড়াও ব্যাঙ্গালোর হয়ে প্রশান্তি নিলয়ম আসা যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে একটু সময় বেশি লাগে। পরের দিন রাত্রি ১১.২০ মিনিটে পুত্তাপূর্তি স্টেশনে পৌঁছাই। হালকা শীতের আবেশ।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হালকা পেটপূজা সেরে তৈরি হলাম প্রশান্তি নিলয়মে সাঁই বাবার মন্দিরে যাওয়ার জন্য। অটোয় করে যাওয়ার পথে দেখি রাস্তার দুইধারে বিভিন্ন ফুলের বাহার।এয়ারপোর্ট পেরিয়ে প্রথম পাহাড়ি বাঁকটি ঘুরতেই চোখের সামনে একটি বাছুরের দুর্ঘটনায় মৃত্যু দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হলো। ভাবলাম এরা তো ট্রাফিক নিয়ম জানে না, কিন্তু যাঁরা জানেন তাঁরাই বা এত নিষ্ঠুর কেন? একটু সাবধান হলেই এই ধরনের দুর্ঘটনা থেকে অবলা জীবগুলিকে রক্ষা করাই যায়।
মন্দিরের প্রবেশ পথে কড়া নিরাপত্তা বলয়। এখানে কোন রকম নেশার দ্রব্য নিয়ে প্রবেশ করা যায় না। নিরাপত্তা বলয় অতিক্রম করেই সামনে কালো কষ্টি পাথরের গণপতি মূর্তি। ভক্তরা ভক্তিভরে পূজা করছেন।প্রসাদ খেয়ে ,কপালে ভস্মের টিকা লাগিয়ে চললাম উপাসনা কক্ষে। এখানে আরো একবার নিরাপত্তা কর্মীরা পরীক্ষা করলেন। আমার কাছে ক্যামেরা, মোবাইল ফোন ছিল। তাই সে সব জমা রাখতে হলো নি:শুল্ক স্টোর রুমে।
মনমুগধ করা পরিবেশ। মাইকে মৃদু স্বরে সাঁই স্তোত্র পাঠ হচ্ছে। পুরুষ ও মহিলারা আলাদা জায়গায় সারিবদ্ধভাবে বসে ধ্যানে নিমগ্ন। অনেক বিদেশি বিদেশিনী উপস্থিত। একজনের কাছ থেকে বিভূতি সংগ্রহ করে এরই মধ্যে আমার কন্যা কপালে তিলক লাগিয়ে দেয়। মন্দিরের ভিতর কি নেই। ভক্তদের জন্য আবাসন, শপিং মল, বুকস্টল, বিভিন্ন খাবারের স্টল। এ যেন আধুনিকতার ছোঁয়ায় এক প্রাচীন ধারণার গুরুগৃহ। একদিনে সব ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। তাই দুপুরের খাবারের কুপন কেটে কন্যার আবদারে গেলাম শপিং মলে। দিনের বেলায় শপিং মলে মেয়েদের প্রবেশাধিকার থাকে, তাই আমার ঢোকা নিষেধ। অগত্যা বুকস্টল আর চায়ের স্টলে সময় কাটে। ২ঘন্টা পরে গিন্নি ও কন্যা ফিরলেন, এদিকে পেটে ছুঁচো ডাকছে। প্রসাদের জন্য স্টলে গেলাম । প্রসাদ খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে গোপুরম ও ইচ্ছাপূরণ বৃক্ষ দেখা। পাহাড়ের উপর অসংখ্য সিঁড়ি পেরিয়ে এই জায়গাটি অপূর্ব। বিকালে স্পেস থিয়েটারে ঘুরে হোটেলে ফেরা।
পরের দিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। এদিকে প্রবল গতিতে ঝোড়ো হাওয়া। তাই সকালে আর কোথাও না যাওয়াই ভালো। তাই আমি একাই অটো ধরে কচ্ছ বাজারে ঘুরে আসি,ফেরার পথে একটু খাসির মাংস নিয়ে। দুপুরে রান্না করে খেয়ে নিয়ে বেরুই মেডিটেশন ট্রি, মিউজিয়াম ও পুত্তা পূর্তির অন্যতম প্রধান দর্শনীয় জায়গা চৈতন্য জ্যোতি দেখতে। স্টেডিয়ামের পাশে পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে চৈতন্যজ্যোতি দেখে এক স্বর্গীয় অনুভূতি প্রাপ্ত হই আমরা। পাশেই সঙ্গীত বিদ্যালয়, কলেজ সবই সাঁই বাবার তৈরি।একটা পাহাড়ি গ্রামকে কি ভাবে সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দেবভূমিতে পরিনত করা যায় সে শিক্ষাই এখানে দিয়ে গেছেন সত্য সাঁই। গরীব মানুষের জন্য দুটি হাসপাতাল এখানেই তিনি করেছেন। এর মধ্যে একটি আধুনিক সুপার স্পেশালিটি।
পরের দিন একটি অটো বুক করি আরো একটি পরিবারের সাথে। ৮০০ টাকা ভাড়া। আজ সারাদিন আমরা লেপাক্ষী ও পেনাকোন্ডা ঘুরে নেব।
শুনেছি এই দুটি জায়গাও খুব সুন্দর।যদিও আগে কখনো এখানে যায়নি। সকাল ৮ টায় অটো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ি রাস্তা ধরে। কিছু দূর যাবার পরই পাহাড় অতিক্রম করে একটির পর একটি গ্রাম পেরিয়ে সকাল১০ টায় পৌছালাম অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্ণাটকের সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম লেপাক্ষিতে।

বিজয়নগরের রাজারা এই প্রাচীন মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন (১৩৩৬-১৬৪৬)। এই মন্দিরটির গঠনশৈলী বিশ্ববিখ্যাত। মন্দিরের থামগুলি উপর থেকে নিচের দিকে ঝুলন্ত। থামগুলির নিচে দিয়ে অনায়াসেই কাপড়, রুমাল এদিক থেকে ওদিকে নিয়ে যাওয়া যায়। মন্দিরটি শিব, বিষ্ণু ও বী র ভদ্র কে উৎসর্গীকৃত হয়েছে। মন্দিরের ভিতর একটি বড় পাথরের সাপ আছে। মন্দিরে প্রবেশের আগে এক সুবিশাল পাথরের তৈরি নন্দিবুল আছে, যা অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। এখানে একটি ছোট পুষ্করিনী আছে, যেখানে পরে গেলে কেউ আর বেঁচে থাকেন না। সেই কারণে পুলিশ ব্যারিকেড করা থাকে ২৪ ঘন্টা। নিকটবর্তী রেলস্টেশন হিন্দুপুর(১৫কিমি দূরে)।ব্যাঙ্গালোর সিটি স্টেশন এখন থেকে ১২০ কিমি । লেপক্ষী কথার অর্থ বৃহৎ পাখি। কথিত আছে সীতা মাকে নিয়ে রাবন যখন স্বর্গ রথে করে নিয়ে পালাচ্ছেন ,তখন শ্রী রাম ভক্ত জটায়ু পাখি এখানেই রাবণকে বাধা দেন। রাবন তলোয়ার দিয়ে জটায়ুকে আঘাত করলে জটায়ু এখানেই মাটিতে পতিত হন।

লেপক্ষী ঘুরতেই প্রায় দুপুর ১টা বেজে গেল। স্থানীয় হোটেলে দুপুরে লাঞ্চ করে চলতে লাগলাম পেনকোন্ডা শহরে। এক প্রাচীন ধর্মীয় শহর পেনকোন্ডা। প্রাচীন ভারতে অনেক মুনি ঋষি এইখানে গুহায় তপস্যা করতেন। সেই গুহার ভগ্নাবশেষ আজও আছে। বিজয়নগরের রাজার বেশ কয়েকটি দুর্গ আছে পাহাড়ে। বর্তমানে পেনকোন্ডা আধ্যাত্মিক সাধনার তীর্থভূমি। শ্রী কালেশ্বর সোঅল বিশ্ব বিদ্যালয় তৈরি করেছেন বিখ্যাত ধর্মীয় পথপ্রদর্শক কালেশ্বর । এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর একটি মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মাজার আছে। অদ্ভুত সুন্দর ধর্মীয় সহাবস্থান। মনো মুগধকর পরিবেশ।
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চারিদিকে হাওয়া বিদ্যুতের পাখা গুলি বনবন করে পাহাড়ের উপর ঘুরছে। আমাদেরও ফিরতে হবে । তাই ইচ্ছা না থাকলেও ড্রাইভারের আবেদনে ফিরে আসার প্রস্তুতি। গাড়ি চলছে পথেই পড়ল একটি কুম্ভকর্ণের বিরাট মূর্তি। কুম্ভকর্ণের পেটের মধ্যে কিছুক্ষন কাটিয়ে ফিরে এলাম পুত্তাপূর্তি।
পরের দিন ডাক্তার দেখাতে হবে। তাই হোটেলে গিয়ে অনেক কাজ সারতে হবে। রান্না করার ব্যাপারও আছে।

ডাক্তার দেখিয়ে আরো একবার গেলাম রাত্রের প্রশান্তি নিলয়মে। আজ সন্ধ্যায় খুব সুন্দর সাজিয়েছে মন্দির প্রাঙ্গন। অমাবস্যায় বিশেষ কোন পূজাপাঠ আছে। একটু শপিং মল ঘুরে কিছু খাবার কিনলাম ফেরার দিন ট্রেনে খাওয়ার জন্য। ছোট্ট ভ্রমণ অভিজ্ঞতা হলেও এই ভ্রমনটি মনের মনিকোঠায় স্থান পেল জীবনে বেঁচে থাকার রসদ জোগানোর জন্যও।
কি ভাবে যাবেন:- SSPN EXPRESSS এ সত্য সাঁই স্টেশনে নামবেন অথবা ব্যাঙ্গালোর গামী যে কোন গাড়ি ধরে ব্যাঙ্গালোর বা যশোবন্তপুর নেমে লোকাল ট্রেন বা বাসে পুত্তাপূর্তি আসা যায়।
আদর্শ সময়:- সারা বছরই আবহাওয়া ভালো। তবে গরমকাল একটু কষ্টের।
আনুমানিক খরচ :- এক সপ্তাহের জন্য জন প্রতি ৩০০০ টাকা। খুব সস্তায় হোটেল পাওয়া যায়। দিন প্রতি 100-150 টাকায়। রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
সমাপ্ত
--------------------