রমাকান্ত ....✍প্রাণকৃষ্ণ মিশ্র




ছোটগল্প

রমাকান্ত

প্রাণকৃষ্ণ মিশ্র

ছেলেটির নাম রমাকান্ত মুখার্জি। অখ্যাত অজপাড়া গাঁয়ের হাসিখুশি, খোলামেলা চরিত্রের একজন মানুষ। শৈশব থেকেই লেখাপড়ায় খুব একটা মন ছিল না রমাকান্তের। সুদর্শন চেহারার এই যুবক বরং খেলাধুলা, গল্প,আমোদ প্রমোদ, পূজা অর্চনায় বেশি সময় কাটাতেন। কৈশোর থেকে যৌবনের মাটিতে পা দিয়ে আর পাঁচ জন ছেলে মেয়েদের মনে যেমন প্রেম উঁকি দেয় রমাকান্তের ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু সেই প্রেমের কথা পাঁচ কান হতে আঠারো পূর্ন হবার আগেই রমাকান্তের প্রেমিকার বিবাহ দিয়ে দেন তাঁর অভিভাবক। ওই বয়সে রমাকান্তের এহেন আঘাত মনকে বিদীর্ণ করলেও রমাকান্ত নীরবই থাকেন। কারন রমাকান্তেরও বয়স তখন আঠারোয় পৌঁছায়নি। এ বিষয়ে রমাকান্তের মনে দুঃখ ছিল ।



এদিকে রমাকান্তের পড়াশুনায় মন নেই। প্রতি শ্রেণীতেই প্রায় দুইবছর করে থাকতে হয়। এমন সময় রমাকান্তের পিতা প্রথমে ওনাকে বাড়ির গৃহ দেবতার পূজা অর্চনার কাজে যুক্ত করেন। কিন্তু সেদিকেও রমাকান্তের মন স্থির হয় না। বাড়িতে রমাকান্ত বলে সে মেকানিক্সের কাজ শিখবে। সন্তানের যেমন ভাবনা তেমন ব্যবস্থা পাকা হয়। শহরের নামি কোম্পানির গ্যারেজে রমাকান্তকে কাজে যুক্ত করে দেওয়া হয়। তখন রমাকান্ত যৌবনের দরজায় সবে পা দিয়েছে।

অল্প সময়ের মধ্যেই রমাকান্ত শহরের নাম করা মটর মেকানিকের সুনাম অর্জন করেছে। শহর ছাড়িয়ে দক্ষিণবঙ্গে ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শহরে তাঁর নাম ডাক। দুহাতে রোজগার। কিন্তু সেই সময় আকাশছোঁয়া সুখ্যাতি ধরে না রেখে রমাকান্ত সঙ্গদোষে ড্রাগের নেশার কবলে পড়েন। পরিবারের কানে আসে সেখবর। পরিবার পরিজন চিন্তায় মগ্ন। অতীতে এহেন আচরণ পরিবারের অন্য কেউ কোন দিন করেনি। সম্ভ্রান্ত ধর্মপ্রাণ বংশে পুত্রের এহেন আচরণ মেনে নেওয়া যন্ত্রণার। পিতামাতা তাঁরা কর্মস্থল থেকে রমাকান্তকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। সেই সময় পরিজনদের মনে হয়েছিল হয়ত বাড়িতে এলে রমাকান্ত ড্রাগের নেশা ত্যাগ করবেন। নেশা ত্যাগের জন্য শহরের নামকরা হাসপাতালে চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু রমাকান্তের মতিগতির পরিবর্তন হয় না। কারন ততদিনে সর্বনাশা নেশা রমাকান্তকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাঁকিয়ে ধরেছে।

গ্রামে এসেও রমাকান্ত আড়ালে আবডালে খোঁজ করে ড্রাগের। খোঁজ মিলেও যায়। আবার পথ চলা অন্ধকার জগতে। চিকিৎসায় সারা দিয়ে কিছুটা সুস্থ হয় তো, আবার শুরু নেশার।পরিবারে ব্যতিব্যস্ত সকলে। এদিকে একসময় এত সুন্দর সুদর্শন যুবক গ্রামে দ্বিতীয়টি ছিল না। মৃদুভাষী রমাকান্তের মুখে ছিল সদাহাসি। গুরুজনদের প্রতি ছিলেন দায়িত্বশীল। সম্মান করতেন সকলকে। শৈশব থেকেই নিরামিষ আহার করতেন। শরীরে ছিল ভীমের শক্তি। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কুস্তিতে ছিল অপরাজেয়।

এদিকে ভেবে ভেবে পিতামাতার সন্তান চিন্তায় দিন দিন শরীর খারাপ হয়ে উঠছে। এমনই সময় একজন সুহৃদের পরামর্শে রমাকান্তকে পাঠানো হল কলকাতার একটি নাম করা মঠে । মঠের পূজা অর্চনার কাজে এখন থেকে রমাকান্ত যুক্ত। কিছু দিনের মধ্যে মঠের একজন প্রধান সন্ন্যাসীর প্রিয়ভাজন হয়ে যান রমাকান্ত। চিকিৎসা ও মঠের পরিবেশের কারনে সেই সময় রমাকান্তের মতিগতির আমূল পরিবর্তনও হয়েছিল। তখন রমাকান্ত একেবারেই ড্রাগের কবল মুক্ত।

মঠের কাজে একদিন রমাকান্তকে ডেকে প্রধান সন্ন্যাসী বলেন তোমাকে আমার সাথে আমেরিকা যেতে হবে।

রমাকান্ত রাজি।

বাড়িতে মায়ের অনুমতি নেবার জন্য রমাকান্ত আসেন। মা অনুমতি দেন আমেরিকা যাবার।




এরপর রমাকান্তের আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা। দীর্ঘ ৬ মাস আমেরিকায় বসবাস। তখন রমাকান্তের সুদর্শন চেহারায় পুনরায় সূর্যের রশ্মির ছটা। আমেরিকা থেকে পাঠানো ছবিগুলি আজও সেই ইঙ্গিতই করে। কর্মশেষে আমেরিকা থেকে ফিরে আসেন রমাকান্ত। ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি সন্ন্যাস নেবেন। সমস্ত ব্যবস্থা পাকা। কিন্তু ততদিনে রমাকান্তের মনে বাসা বেঁধেছে ড্রাগের কুপ্রভাব। রমাকান্ত মাঝে মাঝে ভুল বকছেন, ক্রোধান্বিত হয়ে তাড়া করে প্রহার করতে যাচ্ছেন অন্যান্য আশ্রমিকদের। প্রথমে আশ্রমের অনেকেই ভেবেছিলেন এমনটা হয়ত ঐশ্বরিক কোন কারনে হচ্ছে। নতুন সন্ন্যাসীর প্রতি হয়ত ঈশ্বরের প্রভাব পড়েছে। কিন্তু তা না, এ হেন আচরণ দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। বাড়ছে অশান্তি।

সংবাদ আসে গ্রামের বাড়িতে। রমাকান্তকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় গ্রামে। শুরু করা হয় পরবর্তী চিকিৎসা। কিন্তু সে চিকিৎসায় সারা দেয় না রমাকান্ত। তখন রমাকান্ত বদ্ধ পাগল। বাড়িতে মা, বাবার উপর শারীরিক নির্যাতন শুরু করেছেন। যাকে পারছেন তাকেই মারতে উদ্ধত। অগত্যা চিকিৎসকের পরামর্শে রমাকান্তের স্থান হয় বদ্ধ কুঠুরিতে। যদিও কখনো বাইরে আনা হতো তখন পায়ে থাকত শিকল বাঁধা। এই ভাবেই কাটতে থাকে রমাকান্তের শেষ ১৫ টি বছর।

একটা সর্বনাশা নেশা কেড়ে নিয়েছিল রমাকান্তের সমস্ত সুখ, স্বাচ্ছন্দ, আনন্দকে। অথচ আমি জানতাম রমাকান্ত ছিলেন রোমান্টিক, সুন্দর মনের এক প্রানবন্ত যুবক। রমাকান্ত দাম্পত্যেরও স্বপ্ন দেখেছিল একদিন। রমাকান্ত স্বপ্ন দেখেছিল প্রচুর রোজগার করে একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ হবার। কিন্তু বেরিয়ে আসতে পারলো না নেশার কুপ্রভাবের কারনে।রমাকান্তের জীবনের শেষ ১০ বছরে বেশ কয়েকবার রমাকান্তের বাড়িতে গিয়েও আমি মুখোমুখি দাঁড়াতে পারিনি ওই অন্ধ কুঠুরির সামনে। কারন আমি ঐ রমাকান্তকে দেখতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম রমাকান্ত সুস্থ হোক। আমি চেয়েছিলাম আমার সেই শৈশবের বন্ধুকে। প্রানবন্ত রমাকান্তকে।

কেটে যায় বহু বছর। রমাকান্ত আমার স্মৃতিতে যখনই কড়া নেড়েছে, তখনই খোঁজ নিয়েছি কেমন আছে রমাকান্ত?

আগের থেকে কিছুটা কি ও ভালো আছে?

প্রতিবার উত্তর পেয়েছি পরিজনদের থেকে -"না"।

শুনেছি রমাকান্তকে এখন আর চিনতে পারবি না। শুনেছি রমাকান্ত এখন চোখে কম দেখে।




প্রশ্ন করেছি -ওর পায়ের বেড়িটা কি খোলা হয়েছে?

উত্তর পেয়েছি সব প্রশ্নের- "না"।

তারপর ছেড়ে দিয়েছিলাম প্রশ্ন করা। কারন "না" শুনতে আমার ভালো লাগে না।

তারপর একদিন সব শেষ।

আমি কেদারনাথ থেকে ফিরে শুনি রমাকান্ত এই ইহজগতে নেই। রমাকান্ত এখন পরলোকের বাসিন্দা।

মনে কষ্ট হয়েছে। আবার ভেবেছি ওর বেশিদিন বেঁচে না থাকাই ভালো। আরো কষ্ট পেত।

কামনা করেছি রমাকান্তের আত্মার শান্তি হোক।

চেয়েছি সর্বনাশা ড্রাগের অবলুপ্তি হোক সমাজ থেকে। আর যেন কোন মায়ের সন্তানের এমন অবস্থা না হয়। অন্তত যেন আর কোন প্রাণ এমন ভাবে অকালে বিনষ্ট না হয়।

সমাপ্ত
--------------------
ভাষাপথ অ্যাপটি ব্যবহার করবার জন্য ধন্যবাদ। এই অ্যাপটি ভালো লাগেল, অবশ্যই ফাইব ষ্টার রেট দেবেন এবং কমেন্ট করে আপনাদের মতামত জানাবেন এবং সকলের সাথে শেয়ার করে নেবেন।