চোদ্দ শাক চোদ্দ পিদিম ও কালীপুজো ....✍ডাঃ স্বপন কুমার গোস্বামী
ইতিহাস
চোদ্দ শাক চোদ্দ পিদিম ও কালীপুজো
ডাঃ স্বপন কুমার গোস্বামী
এখনো কলকাতার বাজারে কালীপুজোর দিন দুই আগে থেকেই সব সব্জীবিক্রেতা কুচোনো পাঁচ মিশেলী কিছু শাকপাতাকে চোদ্দ শাক বলে বিক্রী করে এবং গেরস্থরা সেই কুচোনো শাকপাতাকে চোদ্দ শাক বলে কিনে নিয়ে যায় । এই বাজারের চোদ্দ শাকে চারটি লাল শাকের সঙ্গে বাজারে যা পাওয়া যায় কলমি ,নটে পুঁই ,লাউ সব মিশিয়ে কুচিয়ে দেয় ।
কবে থেকে এই চোদ্দ শাক খাওয়ার প্রথা চালু হয়েছে বা কেন বছরে একটি বা দুটি দিন চোদ্দ শাক খেতে হবে তার উত্তর অজানা ।তবে এই চোদ্দ শাকের সঙ্গে পন্ডিত রঘুনন্দনের নাম জড়িয়ে আছে । তাঁর মতে – আচারাত চতুর্দশ শাক ভক্ষণম । তিনি এই চোদ্দ শাকের নামও উল্লেখ করেছেন- ১-ওল, ২-কেঊ,৩-বেতো , ৪-কালকাসুন্দে ,৫-নিমপাতা ,৬-জয়ন্তী ,৭-সরিষা ,৮-শাঞ্চে ,৯-হিলঞ্চ,১০-পলতা , ১১-শুলফা .১২-গুলঞ্চ .১৩-ঘেঁটু ,১৪-শুষনী । এ বিষয়ে নামান্তর আছে –পঞ্জিকা এ কথাও বলেছে ।
আমরা গ্রামের ছেলে । তাই ছেলেবেলায় কালিপুজোর দিন বা তার আগের দিন ভাইবোনেরা মিলে চোদ্দ শাক তুলতে বেরোতাম । গাঁয়ের সব বাড়ি থেকেই ছেলে মেয়েরা চোদ্দ শাক তুলতে বের হত । তবে এই চোদ্দ শাকের নামও কেউ জানত না ,আর এই সব শাক এখনও চোখে দেখি নি বা কাউকে খেতে শুনিনি । ওল এর ডাঁটা খেয়েছি ,কিন্তু ওল শাক খাইনি বা ওলশাক বলে আলাদা কিছু আছে বলে জানি না । তেমনি জানি না বা দেখি নি- কেউ, জয়ন্তি ,শাঞ্চে বা শুলফা শাক কি জিনিস । শুষনি, বেতো শাক তুললেও চোদ্দ শাকের মধ্যে – নিমপাতা, গুলঞ্, ঘেঁটু পাতা কোনদিন যোগ করিনি ।
তবে যে সব চেনা শাক পেতাম সেগুলি তুলে এনে কেটে মিশিয়ে ভেজে খেতে খুবই ভাল লাগত । তবে তাতে চোদ্দ শাকের মধ্যে গোটা পাঁচের বেশি যে শাক থাকত না এ বিষয়ে নিশ্চিত ।এখনও থাকে না ।
এবার চোদ্দ পিদিমের কথায় আসি । আমার গল্প পাঁচের দশকের । সবে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চালু হয়েছে ।পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম তখন বিভূতিভূষণে্র গ্রাম , কুমুদরঞ্জনের গ্রাম , জসীম উদ্দীনের গ্রাম । সহরের কোন সুবিধেই সেখানে নেই । পিদিম হাটে বিক্রী হত না ঘরে তৈরি করে নিতে হত । কালীপূজোকে দেওয়ালি বা পিদিমকে দিয়া বলা শুরু হয় নি । ধনতেরাস শব্দটি বাঙ্গালীরা কেউ শোনেই নি । বস্তুত; আমি শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি ২৫ বছর বয়সে । তাও সোনা কেনার জন্যে নয় –সস্তায় স্টিলের বাসন কেনার দিন হিসেবে । এখন ধান্ধাতেরাস – বিজ্ঞাপনের চটকে লোকে বিনা পয়সায় বা কম দামে সোনা কিনতে পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছে ।
ধনতেরাস দেওয়ালি দিয়া বাদ দিয়ে পাতি বাঙ্গালীর কালীপুজোয় ফিরে যাই । কালীপুজোর সন্ধ্যেয় ঘরে ঘরে পিদিম জ্বালাবার জন্য মাটি মেখে পিদিম তৈরি করে রোদে ভালভাবে শুকোন হত । তারপরে সলতে পাকানোর পালা । ঘোর অমানিশায় দেবগৃহাদৌ দীপদানম । মা পিদিমে তেল দিয়ে সলতে জ্বালিয়ে একটা একটা পিদিম আমাদের হাতে দিত । আমরা সেই পিদিমটা হাতে ধরে “ভুত পালালো ,ভুতের আলো , ভুতের মাথায় পিদিম জ্বালো ” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে সদর দরজা ,খিড়কি দরজা , তুলসী তলা , গোয়াল ঘর সর্বত্র পিদিম দিয়ে দীপাবলী উদযাপন করতাম । তখন বিজলী আলো ছিল না । নিশ্ছিদ্র ঘোর অন্ধকারে আশেপাশের গ্রামের প্রদীপের আলোয় সারা এলাকায় এক অপূর্ব শোভা সৃস্টি করত । সন্ধ্যের ট্রেনে চেপে বর্ধমান থেকে হাওড়া গেলে দূর গ্রামের আলোর সারি ,বাজির হটাত আলোর ঝলকানি, গাছের ফাঁক দিয়ে দূর মাঠের মাঝে হটাত সামনে এসে পরা বুড়ি পোড়ানোর জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা অন্ধকারের বুক চিরে খুব সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করত ।
এ ছাড়া কালীপুজোর রাতে গ্রামের ছেলেদের আরো একটি আনন্দের বিষয় ছিল বুড়ি তৈরি করে পোড়ান । একটা বাঁশ এর চার দিকে কলাপাতা খড় জড়িয়ে বেঁধে বুড়ি তৈরী করে মাঠের ধারে বা পুকুরের ধারে পোঁতা হত । সন্ধ্যে বেলায় সেই বুড়ি পোড়াবার সময় –ছেলেরা বলত –আঁজোরে পুঁজোরে বুড়ির গায়ে আগুন দে রে । পুকুরের ধারে পর পর বুড়ি পোড়ানোর সঙ্গে ছেলেপুলেদের চিৎকার আনন্দের নতুন মাত্রা যোগ করত ।
গেরস্থ বাড়িতে কালীপুজোর রাতে শ্রী শ্রী মহালক্ষ্মী পুজো এবং অলক্ষ্মী পুজো হত ।কলার পেটোয় গোবর দিয়ে অলক্ষ্মী তৈরি করে কি মন্ত্রে পুজো হত জানি না । তবে কুলোর বাতাস দিয়ে অলক্ষীবিদায় পর্বটি ঘটা করেই হত । অলক্ষ্মী বিদায় করে লক্ষ্মীকে ঘরে প্রতিষ্ঠা করে কালীপুজোর প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান পর্ব শেষ হত । মহাকালী ও শ্রী শ্রী লক্ষ্মীকে প্রণাম জানিয়ে ডাঃ স্বপন কুমার গোস্বামী ।
কবে থেকে এই চোদ্দ শাক খাওয়ার প্রথা চালু হয়েছে বা কেন বছরে একটি বা দুটি দিন চোদ্দ শাক খেতে হবে তার উত্তর অজানা ।তবে এই চোদ্দ শাকের সঙ্গে পন্ডিত রঘুনন্দনের নাম জড়িয়ে আছে । তাঁর মতে – আচারাত চতুর্দশ শাক ভক্ষণম । তিনি এই চোদ্দ শাকের নামও উল্লেখ করেছেন- ১-ওল, ২-কেঊ,৩-বেতো , ৪-কালকাসুন্দে ,৫-নিমপাতা ,৬-জয়ন্তী ,৭-সরিষা ,৮-শাঞ্চে ,৯-হিলঞ্চ,১০-পলতা , ১১-শুলফা .১২-গুলঞ্চ .১৩-ঘেঁটু ,১৪-শুষনী । এ বিষয়ে নামান্তর আছে –পঞ্জিকা এ কথাও বলেছে ।
আমরা গ্রামের ছেলে । তাই ছেলেবেলায় কালিপুজোর দিন বা তার আগের দিন ভাইবোনেরা মিলে চোদ্দ শাক তুলতে বেরোতাম । গাঁয়ের সব বাড়ি থেকেই ছেলে মেয়েরা চোদ্দ শাক তুলতে বের হত । তবে এই চোদ্দ শাকের নামও কেউ জানত না ,আর এই সব শাক এখনও চোখে দেখি নি বা কাউকে খেতে শুনিনি । ওল এর ডাঁটা খেয়েছি ,কিন্তু ওল শাক খাইনি বা ওলশাক বলে আলাদা কিছু আছে বলে জানি না । তেমনি জানি না বা দেখি নি- কেউ, জয়ন্তি ,শাঞ্চে বা শুলফা শাক কি জিনিস । শুষনি, বেতো শাক তুললেও চোদ্দ শাকের মধ্যে – নিমপাতা, গুলঞ্, ঘেঁটু পাতা কোনদিন যোগ করিনি ।
তবে যে সব চেনা শাক পেতাম সেগুলি তুলে এনে কেটে মিশিয়ে ভেজে খেতে খুবই ভাল লাগত । তবে তাতে চোদ্দ শাকের মধ্যে গোটা পাঁচের বেশি যে শাক থাকত না এ বিষয়ে নিশ্চিত ।এখনও থাকে না ।
এবার চোদ্দ পিদিমের কথায় আসি । আমার গল্প পাঁচের দশকের । সবে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চালু হয়েছে ।পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম তখন বিভূতিভূষণে্র গ্রাম , কুমুদরঞ্জনের গ্রাম , জসীম উদ্দীনের গ্রাম । সহরের কোন সুবিধেই সেখানে নেই । পিদিম হাটে বিক্রী হত না ঘরে তৈরি করে নিতে হত । কালীপূজোকে দেওয়ালি বা পিদিমকে দিয়া বলা শুরু হয় নি । ধনতেরাস শব্দটি বাঙ্গালীরা কেউ শোনেই নি । বস্তুত; আমি শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি ২৫ বছর বয়সে । তাও সোনা কেনার জন্যে নয় –সস্তায় স্টিলের বাসন কেনার দিন হিসেবে । এখন ধান্ধাতেরাস – বিজ্ঞাপনের চটকে লোকে বিনা পয়সায় বা কম দামে সোনা কিনতে পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছে ।
ধনতেরাস দেওয়ালি দিয়া বাদ দিয়ে পাতি বাঙ্গালীর কালীপুজোয় ফিরে যাই । কালীপুজোর সন্ধ্যেয় ঘরে ঘরে পিদিম জ্বালাবার জন্য মাটি মেখে পিদিম তৈরি করে রোদে ভালভাবে শুকোন হত । তারপরে সলতে পাকানোর পালা । ঘোর অমানিশায় দেবগৃহাদৌ দীপদানম । মা পিদিমে তেল দিয়ে সলতে জ্বালিয়ে একটা একটা পিদিম আমাদের হাতে দিত । আমরা সেই পিদিমটা হাতে ধরে “ভুত পালালো ,ভুতের আলো , ভুতের মাথায় পিদিম জ্বালো ” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে সদর দরজা ,খিড়কি দরজা , তুলসী তলা , গোয়াল ঘর সর্বত্র পিদিম দিয়ে দীপাবলী উদযাপন করতাম । তখন বিজলী আলো ছিল না । নিশ্ছিদ্র ঘোর অন্ধকারে আশেপাশের গ্রামের প্রদীপের আলোয় সারা এলাকায় এক অপূর্ব শোভা সৃস্টি করত । সন্ধ্যের ট্রেনে চেপে বর্ধমান থেকে হাওড়া গেলে দূর গ্রামের আলোর সারি ,বাজির হটাত আলোর ঝলকানি, গাছের ফাঁক দিয়ে দূর মাঠের মাঝে হটাত সামনে এসে পরা বুড়ি পোড়ানোর জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা অন্ধকারের বুক চিরে খুব সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করত ।
এ ছাড়া কালীপুজোর রাতে গ্রামের ছেলেদের আরো একটি আনন্দের বিষয় ছিল বুড়ি তৈরি করে পোড়ান । একটা বাঁশ এর চার দিকে কলাপাতা খড় জড়িয়ে বেঁধে বুড়ি তৈরী করে মাঠের ধারে বা পুকুরের ধারে পোঁতা হত । সন্ধ্যে বেলায় সেই বুড়ি পোড়াবার সময় –ছেলেরা বলত –আঁজোরে পুঁজোরে বুড়ির গায়ে আগুন দে রে । পুকুরের ধারে পর পর বুড়ি পোড়ানোর সঙ্গে ছেলেপুলেদের চিৎকার আনন্দের নতুন মাত্রা যোগ করত ।
গেরস্থ বাড়িতে কালীপুজোর রাতে শ্রী শ্রী মহালক্ষ্মী পুজো এবং অলক্ষ্মী পুজো হত ।কলার পেটোয় গোবর দিয়ে অলক্ষ্মী তৈরি করে কি মন্ত্রে পুজো হত জানি না । তবে কুলোর বাতাস দিয়ে অলক্ষীবিদায় পর্বটি ঘটা করেই হত । অলক্ষ্মী বিদায় করে লক্ষ্মীকে ঘরে প্রতিষ্ঠা করে কালীপুজোর প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান পর্ব শেষ হত । মহাকালী ও শ্রী শ্রী লক্ষ্মীকে প্রণাম জানিয়ে ডাঃ স্বপন কুমার গোস্বামী ।
সমাপ্ত
--------------------