আবদুল কালামের জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ....✍কমল বিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
অন্যরকম
আবদুল কালামের জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা
কমল বিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
(১৫ অক্টোবর ১৯৩১-২৭ জুলাই ২০১৫)
ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি আবুল পকির জয়নুল আবেদিন আবদুল কালাম এক মৎস্যজীবী পরিবারের সন্তান। ১৫ অক্টোবর ১৯৩১ সালে মাদ্রাজের অন্তর্গত দ্বীপশহর রামেশ্বরমে তাঁর জন্ম। খেয়া পারাপার করা ছিল আবদুল কালামের পিতার মূল জীবিকা। তীর্থযাত্রী নিয়ে তিনি রামেশ্বরম থেকে ধনুষ্কোডি (অন্য নাম সেতুক্কারাই) যেতেন এবং তাদের নিয়ে আবার ফিরে আসতেন। সরল সাধাসিধে জীবনযাত্রার সঙ্গে আধ্যাত্মিক আলোচনা করতে তিনি ভালোবাসতেন। প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে তিনি নামাজ পড়তেন। তারপর প্রাতঃভ্রমণে বের হতেন। তখন সূর্য পূর্ব আকাশে উঁকি দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রায় চার মাইল হেঁটে তাঁদের পারিবারিক নারকেল বাগানে পৌঁছতেন। গাছ থেকে দশ-বারোটা নারকেল পেড়ে কাঁধে ঝুলিয়ে ফিরে আসতেন। এইভাবে নিয়ম মেনে দিন কাটছিল ভালোই। কিন্তু সবকিছু তছনছ হয়ে গেল যেদিন ঘন্টায় একশো মাইল বেগে ধেয়ে আসা সাইক্লোন রামেশ্বরমের সমুদ্রতটে আছড়ে পড়ল। সেই ঝড়ের দাপটে উড়ে গেল নৌকো, সমুদ্রের জলে তলিয়ে গেল ধনুষ্কোডি তথা সেতুক্কারাইয়ের একটি অংশ। তীর্থযাত্রীদের আসা-যাওয়া বন্ধ। খেয়া পারাপার বন্ধ। এই তামিল-মুসলমান পরিবারটির তখন দিশেহারা অবস্থা। আবদুল কালাম ধর্মীয় ও সরল সাধাসিধে পরিবেশে মানুষ হয়েছেন। তবে ধর্মের গোঁড়ামি তাঁদের পরিবারে ছিল না। রামেশ্বরম মন্দিরের বড় পুরোহিত পক্ষী লক্ষ্মণ শাস্ত্রী ছিলেন আবদুল কালামের বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনের বেশবাস প্রথা অনুযায়ী হলেও প্রায়শই তাঁরা আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। হিন্দু ও মুসলমান— উভয় পরিবেশ ও সান্নিধ্যে বড় হয়েছেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন মুক্তমনা।
সাত ভাই বোনের মধ্যে আবদুল কালাম ছিলেন সবার ছোট। মৎস্যজীবী এই দরিদ্র পরিবারে পড়াশোনার রেওয়াজ তেমন ছিল না। দাদাদের ছিল মুদি ও ঝিনুক বিক্রির দোকান। সময় পেলেই পরিবারের এই ছোট ছেলেটি দাদাদের সাহায্য করতেন। তা সত্ত্বেও আবদুল কালামের মা স্বপ্ন দেখতেন যে তাঁর ছোট ছেলে পড়াশোনা শিখে যশ ও কীর্তির অধিকারি হবে। মা-র সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল। তবে চলার পথ মসৃণ ছিল না।
অভাব অনটনের সংসার। পরিবারের সবার জন্য ভাত-রুটির ব্যবস্থা করতেই হিমসিম খেতে হয়। তা সত্ত্বেও আবদুল কালামের মা মাঝে মাঝে নিজে না খেয়ে ছোট ছেলেকে দুটো রুটি বেশি দিতেন। সংসারের খরচ থেকে দুটো পয়সা বাঁচিয়ে বাড়তি কেরোসিন কিনতেন, রাতে ছেলে পড়াশোনা করবে বলে। তাঁর যে স্বপ্ন, ছোটো ছেলে একদিন দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তি হবে। ছেলে মা-কে হতাস করেন নি, তাঁর স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন। একদিনের একটা ঘটনার কথা বলি। রাতে খেতে বসে তিনি কটা রুটি খেয়েছিলেন হিসেব ছিল না। যতক্ষণ চেয়্ছেন মা-ও দিয়ে গেছেন। একটা মাত্র ঘর। দুটো খাটিয়া। তাতেই সবাই গাদাগাদি করে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। রাত তখন প্রায় এগারোটা হবে। আবদুল কালামের দাদা ভাই-কে ডেকে বললেন, ‘জানিস আজ মা কিছু খায় নি’?
‘কেন?’ দাদার দিকে তাকিয়ে আবদুল কালাম জিজ্ঞেস করলেন।
‘কী করে খাবে, তুই তো সব খাবার খেয়ে নিয়েছিস’ উত্তরে দাদা বললেন।
দাদার কথা শুনে আবদুল কালামের ঘুম ছুটে গেল। ভীষণ কষ্ট হতে লাগল। খাটিয়ার উপর বসে দু-হাঁটুর মাঝখানে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। কান্না মায়ের কানে পৌঁছতে উঠে এসে ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘কাঁদে না বাবা, পৃথিবীর অনেক মা-ই ছেলেমেয়েদের জন্য এটুকু করেন। ঘুমিয়ে পড়।‘ এই বলে তিনি ছেলের চোখের জল মুছিয়ে গায়ে-মাথায় স্নেহ ভরা হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
দশ বছর বয়সে ঘটা এই ঘটনাটি আবদুল কালাম কোনোদিন ভুলতে পারেন নি। পরবর্তী জীবনে তিনি এই ঘটনাটিকে নিয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটির শেষ অংশ এই রকম—
---------------------------------------
I still remember the day when I was ten,
Sleeping on your lap to the envy of my elder brothers and sisters
It was full moon night, my world only you new
Mother! My Mother!
When at midnight I woke with tears falling on my knee
You knew the pain of your child, My Mother.
Your caring hands, tenderly removing the pain
Your love, your care, your faith gave me strength
To face the world without fear and with His strength.
We will meet again on the great Judgment-day, My Mother!”
[ কবিতাটির এই শেষ অংশটি তাঁর “Wings of Fire” বইটির শুরুতে মুদ্রিত আছে। তাঁর কথাতেই কবিতাটির অংশটুকু ইংরেজিতেই দিলাম। ]
সুত্রঃ বইয়ের নাম-‘এ পি জে আবদুল কালামঃ জীবন ও সাধনা’, লেখক-কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রকাশক-বেস্টবুক্স্, কলকাতা।
15. 10. 2018
সমাপ্ত
--------------------