গল্প যখন ভ্রমণ ....✍প্রাণকৃৃষ্ণ মিশ্র




ভ্রমণ

গল্প যখন ভ্রমণ

প্রাণকৃৃষ্ণ মিশ্র


ট্রেকিং করার অতীত অভিজ্ঞতা ছিল না। বাড়ি থেকে বেরুনোর কয়েকদিন আগে এক বন্ধু ট্রেকিং এ যাব শুনে, তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বলল “প্রাণ তুই ট্রেকিং এ যাবি শুনলাম। পা গুলো ফেরার সময় বেঁধে নিয়ে আসিস”।
আমি বললাম কেন ভাই , পারবো না?
বলল আগে কখনো কোন ট্রেকিং করেছিস? ট্রেনিং নিয়েছিস কখনো কোথাও?
আমি বললাম তা নিইনি। তবে আমাদের টীমে দুজন আছেন। অনির্বান ও সোমনাথ দা । ওরা আগে কয়েকটি ট্রেকিং করেছে। ওরাই ভরসা।
আরও বললাম দেখ ভাই, কৃষ্ণের বন্ধু সুদামা পাহাড়, নদী, জঙ্গল ,মরুভূমি পেরিয়ে যদি কৃষ্ণকে দেখতে দ্বারকায় আসতে পারে বউকে নিয়ে তাহলে আমিও পারব মনের জোরে এ যাত্রায় উতরে যেতে। আর টিকিট কাটা হয়ে গেছে। এখন যদি যাব না বলি তাহলে দু অক্ষর, চার অক্ষরের অনেকগুলি কথা শুনতে হবে।

আবার সেই তাচ্ছিল্যের হাসি। তাচ্ছিল্য আমার একদম না পসন্দ। তাই কথা বেশি না বাড়িয়ে প্রসঙ্গ এড়িয়ে চললাম। কিন্তু মনে একটা ভয় সেই দিন ঢুকে গেল। রাতের ঘুম উড়ে যাবার জোগাড়। যতই যাবার দিন কাছে আসে।

এদিকে বাড়িতেও রাগারাগি। আসলে ইউ টিউবে জংরির বেশ কয়েকটি ভিডিও আমি গিন্নিকে দেখিয়েই ভুল করেছিলাম। তবুও যে যার সাথে ঘর করে সে তাকে হাড়ে হাড়ে চেনে। তাই আমার জেদের কাছে পেরে ওঠে না।

যাবার দিন সবাই একে একে নিজ নিজ স্টেশনে ট্রেনে উঠি। খুব মজা ও হয়। কিন্তু ভয় আমার পিছু ছাড়ে না। ইয়াকসাম থেকে যেদিন হাঁটা শুরু করলাম তখন সকাল ৭টা বাজে। আগের দিন রাত্রে মুষলধারে বৃষ্টি। তবে সকালে কয়েকবার ইলিশ গুঁড়ি বৃষ্টি ছাড়া খুব জোরে বৃষ্টি আমরা পাইনি। যতই হাঁটছি ততই মনের জেদ ও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। কাঞ্চনজঙ্গা জাতীয় উদ্যানে প্রবেশের আগেই একটি ঝুলন্ত ব্রিজ।
বর্ষাকাল। এবছরই এপ্রিল মাসে। তাই জঙ্গল সবুজ, নদী তার হারিয়ে যাওয়া যৌবন ফিরে পেয়ে বাঁধ ভাঙ্গা উল্লাসে মত্ত। কিন্তু এখানে পৌঁছে একটু ভয় পেলাম।
জাতীয় উদ্যানের দরজার ফলকে দেখি ভাল্লুক, সাপ, চিতার ছবি।
আমি তো অনির্বানকে কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞাস করলাম ভাই এখানে কি এসব আছে?
অনির্বান বলল , দাদা এটা তো কাঞ্চনজঙ্গা জাতীয় উদ্যান। আর জাতীয় অভয়ারণ্যে এসব তো থাকবেই। তবে একসাথে হাঁটলে তেমন একটা ভয় নেই।

ভয় নেই বললে কি আর হয়। বুকে ভয় জগদ্দল পাথরের মত জমিয়ে বসল। এদিকে পোর্টাররা ও আমাদের গাইড লখি ভাই এখনও আমাদের ধরতে পারিনি। আসলে একটু পা জোরে চালিয়েছিলাম আমরা। তাই এরপর একটু ধীর গতিতে এগুতে লাগলাম।
কিছু দূর যাবার পর কয়েকটি মোটবাহী ঘোড়া দেখলাম আমাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। ওদের যেন বড্ড তাড়া। তবে বুকে একটু সাহস পেলাম। এদের ছেড়ে চিতা কি আর আমাদের ধরবে? ওদের গায়ে মাংস বেশি। আর আমরা তো ভেজাল খাওয়া শহুরে মানুষ। বাঘ নিশ্চয় ভেজাল খাবার খাবে না।

কিছুটা হাঁটার পর গাইড আমাদের ধরল। বলল “সাবজি সাচেন মে রুখেঙ্গে। নাস্তা করনা হোগা। আপ লোগ আরামসে আইয়ে”। আমি জিজ্ঞাস করলাম ভাই কোন ভয় নেই তো রাস্তায়? ওরা হাসলো।
কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা সাচেন পৌঁছালাম। এই প্রথম সাচেন এসেই বন্য র আক্রমনের সামিল। রাজীব দেখি লাফিয়ে উঠল। ওর হাত দিয়ে গল গল করে রক্ত। ওকে জোঁকে ধরেছে। নুন দিয়ে জোঁক ছাড়িয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে মনে মনে বনবিবিকে একটা প্রণাম ঢুকলাম। যদিও আমরা সুন্দরবনে নেই। সুন্দরবনে মানুষ বনবিবিরর পূজা করে বাঘের হাত থেকে বাঁচতে।তবুও এটাও তো একটা জঙ্গল। আর এই জঙ্গলেও রয়েল বেঙ্গলের মতোই নরখাদক আছে। সব জাতভাই। একজনকে প্রণাম করলে আর একজন যদি একটু সন্তুষ্ট হয়, তাই।

যাই হোক রেস্ট নিয়ে আবার হাঁটা শুরু। বর্ষাকাল, তাই মাঝে সাঝে ইলিশ গুঁড়ি বৃষ্টি। কখনো পঞ্চু পড়ছি আবার বৃষ্টি থামলেই গরমে খুলে ফেলা। কিছুদূর হাঁটার পর চড়াই বাড়ছে। সাথে শ্বাসকষ্ট। দ্বিতীয় ,তৃতীয় ব্রিজ অতিক্রম করলাম। পথের পাথরগুলি কোথাও পিচ্ছিল, কোথাও বা এবড়ো থেবড়ো। কয়েকটি জায়গায় ধ্বস নেমেছে। পোর্টাররা গাছের ডালপালা দিয়ে কিছুটা মেরামত করার ব্যবস্থা করেছে। এখন আমরা বাকহিম এর পথে।

আকাশ, পাহাড়, জঙ্গল প্রকৃতি রাস্তা সবই পরিবর্তিত হচ্ছে। একটি জায়গায় সতর্কতার নোটিশ বন দপ্তরের।
লখি বলল বাবুজি সাবধানে হাঁটুন। উপর থেকে এখানে পাথর পড়ে। পাহাড় ভাঙ্গছে। নরম মাটি।
আমি লখিকে বললাম বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে জীবন বাজি রেখে ভাই এই পথে এসেছি। আগে মৃত্যু ভয় যেটুকু ছিল ,তা আর নেই। বিকাল নাগাদ বাকহিম পৌঁছালাম।
বাকহিম ট্রেকার্স হাট থেকে হিমালয়ের যে শোভা দেখলাম তা অবর্ণনীয়। এ যেন মেঘের রাজ্যে আমরা। ট্রেকার্স হাটে গরমা গরম চা, বিস্কুট চানাচুর সহযোগে পেটপূজা।
অনির্বান দেখি গাইডকে সঙ্গে নিয়ে তাঁবু ফেলার জায়গা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি বললাম ভাই আরও একটু যাব।

কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটার সিদ্ধান্ত। আর মাত্র ৫ কিমি।
মনে পড়ল সেই বন্ধুটিকে, যে বলেছিল “ পা খুলে যাবে, বেঁধে আনতে হবে”।
যাই হোক এসব চিন্তা করতে করতেই আমরা পৌঁছে গেলাম তোসকা।
এ যেন স্বর্গ। চারিদিকে রোডডেনড্রনের বাগান। এ যেন স্বর্গ থেকে দেবতারা এসে মনের মত করে সাজিয়ে গেছে। তোসকা জুড়ে শুধুই স্ট্রবেরি। ইট খুশি তুলে খাও। বারন করার মত কেউ নেই।

তবে মন বলল যতটুকু খাবার প্রয়োজন ততটুকুই খাও। কারন হিমালয় এই সব ফসল সাজিয়ে রেখেছে তার প্রিয় সন্তানদের জন্যই। আমাদের মত শহুরে মানুষদের বিলাসিতার জন্য কখনোই না। হিমালয় জুড়ে বিভিন্ন নাম না জানা পাখি, পশুর অবাধ বিচরণ।এসব ফল, ফুল তো তাদেরই জন্য।
দুই রাত থেকে স্থানীয় গুম্ফা সহ জংরির পথে আরো কিছুটা হেঁটে ফিরে আসা। কারন আমাদের হাতে খুবই কম সময়। সাথে প্রকৃতির স্নেহ মাখা অঝরা বৃষ্টি।
তাই ফিরে আসা।
তবে হ্যাঁ , কিছু জোঁকের কামড় ছিল সারা শরীরে। কিন্তু তা ছিল যেন স্নেহ। কষ্ট ছিল, কিন্তু তা আনন্দের কাছে হার মেনেছিল।

সমাপ্ত
--------------------
ভাষাপথ অ্যাপটি ব্যবহার করবার জন্য ধন্যবাদ। এই অ্যাপটি ভালো লাগেল, অবশ্যই ফাইব ষ্টার রেট দেবেন এবং কমেন্ট করে আপনাদের মতামত জানাবেন এবং সকলের সাথে শেয়ার করে নেবেন।