স্বপ্ন ....✍প্রাণকৃষ্ণ মিশ্র
গল্প
স্বপ্ন
প্রাণকৃষ্ণ মিশ্র
সুমন গ্রামের ছেলে। পড়াশুনায় মেধাবী, সেই কারণে সুমনের বাবা গ্রাম থেকে শহরে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে আসে। শহরে একটি মুদিখানা দোকানে কাজ করে ওর বাবা।
মাধ্যমিকে শহরের স্কুল থেকে ৮৫ শতাংশ নম্বর নিয়ে সুমন পাশ করে।
অভাবী সংসারে একমাত্র উপার্জন করেন সুমনের বাবা। সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। সুমনের ইচ্ছা বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার। কিন্তু অভাবের সংসারে ওর বাবার বিজ্ঞান নিয়ে যে পড়ানো সম্ভব নয়, তা সুমন বিলক্ষণ বোঝে। তাই বাবাকে চাপ দেয়নি।
ছেলের পড়াশুনার জন্য সুমনের মা , বাবার অমতেই রাখির কারখানায় কাজ করতে শুরু করে। স্কুলের শিক্ষকরাও চেয়েছিল সুমন বিজ্ঞান নিয়ে পড়ুক। কিন্তু তাতে রাজি করাতে পারেনি সুমনকে। তবে কলা বিভাগের শিক্ষকরা সুমনের প্রাইভেট টিউশনির টাকা কেউই নিতেন না।
অভাবের সংসারে কিছুটা সাহায্যের জন্য সুমন পাড়ারই এক ধনীর মেয়েকে পড়াতে শুরু করে।
উচ্চ মাধ্যমিক ও গ্রাজুয়েশন উভয় পরীক্ষায় সুমন প্রথম ডিভিশনে স্টার মার্ক্স নিয়ে পাশ করে।
আশালতা সুমনের ছাত্রী । সুমন এখন আর আশাকে পড়ায় না। একদিন রাস্তায় সুমনের সাথে আশার দেখা হতে, আশা জানতে চায় সুমন দা কেমন আছো? বাড়ির সকলে কেমন আছেন?
সুমন মৃদু স্বরে উত্তর দেয় ভালো ।
উত্তরটা আশার পছন্দের হলেও কেমন যেন লাগে।
আশা বলে- এত দাড়ি কেন মুখে? আগে তুমি কত সুন্দর দেখতে ছিলে। দাড়ি রেখে বিচ্ছিরি লাগছে তোমায়। প্লিজ কেটে ফেলো।
সুমনের চোখ ছলছলে, আশার দৃষ্টি এড়ায়নি।
আশা বলে কি হলো? কাঁদছো?
সুমন বলে এম এর এডমিশন । অনেকগুলি টাকার প্রয়োজন । এখনো জোগাড় হয়নি। বাবাও আর আগের মত বেতন পায় না। দোকানের মালিক বাবার বয়স হয়েছে বলে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছে।
আশার চোখে জলে ভরে যায়।
আশা বাড়ি গিয়ে মায়ের সাথে কথা বলে পরের দিন সকালে সুমনের বাড়ি যায়। ভর্তির টাকা জোগাড় হয়েছে সুমন দা। মা দিয়েছেন।
সুমন লজ্জা পায় নিতে। আশা ৫০০০ টাকা সুমনের বুক পকেটে গুঁজে দেয় একেবারে জোড় করেই প্রায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার সময় সুমন বাসের এক কোনে বসে ভাবে তার ছাত্রীর কথা। ভাবে এমনও হয়?
২০১২ সালে সুমন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়।
অভাবের সংসারে সুমনের PHD করার ইচ্ছা থাকলেও আর সম্ভব হয়নি। এখন সুমনের দরকার একটা চাকুরী। বিভিন্ন পরীক্ষায় সুমন বসে কিন্তু একটিতেও সুমন যোগ্যতা থাকলেও পাশ করতে পারে না।
ভালো ছেলে । ভালো চাকুরীর যোগ্যতা থাকলেও সুমন সেই সব চাকুরীর পরীক্ষায় পাশ করতে পারে না। এখন কম্পিটিশনের যুগ। তাই পরীক্ষায় ভাল ফল করতে গেলে শহরের নামি প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর পরীক্ষার কোচিং নিতে হয় ,সুমন জানে। কিন্তু উপায় নেই, অর্থ নেই।
রাজ্য সরকারের গ্রূপ ডি ,প্রাইমারি শিক্ষক পরীক্ষাতেও বসেছে। কিন্তু অর্থের জন্য তা আর পাওয়া হয়নি। এদিকে চোখের সামনে সুমন দেখে তারই ছাত্রী আশা প্রাইমারিতে চাকুরী পেয়েছে।মাধ্যমিকে আশা ২য় বিভাগে পাশ করেছিল। গোবলা চাকুরী পেল বিধায়কের অনুগত বলে। অথচ ওই গোবলাই মাধ্যমিকে দুইবার ফেল করেছিল ইংরেজিতে।
পাড়ায় শুনেছে, আশার বাবা ৫লক্ষ টাকা দিয়ে নাকি মেয়ের চাকুরী কিনেছে।
শহরে অনেকেরই যোগ্যতা সুমনের থেকে বেশি। সুমন চাকুরী পায়নি, অথচ আশা, গোবলারা চাকুরী করে। সুমন ভাবে এযুগে চাকুরী পাওয়াটাই তো যোগ্যতার মাপকাঠি। কে কতটা সফল তাই তো তার মাপকাঠি। সে সৎ পথে সফল না অসৎ পথে সফল আজকাল তা বিচার্য নয়। এসব ভাবতে ভাবতেই সুমনের চোখে জল আসে। তবুও সুমন শক্ত। মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়।
সুমন এখন টিউশনি পড়ায়। অভাবের সংসারে সেই একমাত্র উপায়ী। বাবা মায়ের বয়স হয়েছে। তাই সকাল থেকে সন্ধ্যা সুমনের নিত্যদিন কাটে আগামী দেশের ভবিষ্যৎ তৈরিতে।
একদিকে হতাশা অন্যদিকে সুমনের জীবনে বেঁচে থাকার লড়াই অন্যদিকে বৃদ্ধ পিতা মাতার মুখে অন্ন জোগানোর তাগিদ ,ঔষধ খরচ। ডুকরে ডুকরে কাঁদে নদীর ধারে বসে,এসমাজকে সুমন ঘৃণা করতে শুরু করে। সমাজে প্রকৃত শিক্ষার মূল্য নেই, চিকিৎসা- সেও ধনীর জন্য, মাথা গোঁজার এক চিলতে নিজেস্ব বাড়ি ও নেই সুমনদের। মাসে 3000 টাকা ঘর ভাড়া ,সংসার খরচ বহন করতে সুমনকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও রাতের পর রাত জাগতে হয়। রাত ১০ টায় বাড়ি ফিরে ও আরো দুই ঘন্টা রাখি বানায়। এরই মধ্যে বাবা সেরিব্রাল এট্যাকে মারা গেলেন। পয়সার অভাবে বাবার পারলৌকিক কাজ করতে পারেনি। যদিও ঈশ্বর ভক্তি কোন কালেই সুমনের ছিল না। সুমন ভাবত ঈশ্বর সেতো ধনীর, গরিব বুভুক্ষ মানুষকে ঈশ্বরও পছন্দ করে না। তাই সেই বা কেন ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা দেখাবে?
এদিকে মা ও অসুস্থ। সুগার, উচ্চ রক্তচাপ জনিত অসুখে দীর্ঘদিন ভুগছে। মায়ের চিকিৎসায় কোন রকম কার্পন্যতা সুমন করেনা। যদিও বাবার চিকিৎসার জন্য শেষ সময়ে অর্থ জোগাড় ও করতে পারেনি। সেই বেদনা থেকেই রক্ত জল করেও রাত্রেও সুমন রাখি বানায়। ও বুঝে যায় এই সমাজ, বঞ্চনার আসল চেহারা।
সুমন ঘৃণা করে এই সংস্কৃতিকেও। যে সংস্কৃতির আমদানি করা হয়েছে সেই ইংরেজ আমল থেকে। ওর দুঃখের কথা একমাত্র বোঝে শহরের এক দাদা। ওরা দুজনে কয়েকবার কলকাতাতেও গিয়েছিল। মিটিং করেছে কয়েকজনের সাথে। তারাও সকলেই শিক্ষিত ভদ্রলোক। ও ভালোবাসে ফেলে তাদের। ওরা সকলেই নতুন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখে। এ সমাজে গরিব শোষিত মানুষের বঞ্চনা নিয়ে আলোচনা করে।
সুমন নিজের ব্যক্তি জীবন নিয়েও তাদের সাথে চর্চায় মেতে ওঠে। কিন্তু এই ভাবেই কয়েক মাস চলতে না চলতেই একদিন সুমনের বাড়িতে পুলিশ এসে কড়া নাড়ে। সুমনের অসুস্থ মা দরজা খুলে দিতেই পুলিশ ঘরে ঢুকে পড়ে সুমনের মাকে ঠেলে। তন্ন তন্ন করে বিছানার তলায়, আলমারি, সুমনের বইয়ের ট্যাঙ্কটি ভেঙে কিছু কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করে। সুমন তখনও বাড়ি ফেরে নি।
সেদিন একটু বৃষ্টি পড়ায় সুমনের পড়াতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফেরার পথে পাড়ার এক ছোট্ট ছেলে রাস্তায় সুমনকে দাঁড় করিয়ে প্রথম পুলিশ আসার কথা বলে।
প্রথমে সুমন বিশ্বাস করেনি। পরে আরো কিছুটা আসার পর দেখে পাড়ার মোড়ে জটলা। সুমন তখনই পুরা বিষয়টি আঁচ করে। তাই বাড়ি ফিরতে একটু দেরি করে।
রাত্রি তখন ১টা। সুমন ছটফট করছে, ওর মা কি ভাবছে, কি করছে এই ভেবে। পাড়ার মোড়ে একটি জায়গায় সাইকেলটি রেখে নিঃশব্দে বাড়িতে এসে জানালা দিয়ে মাকে ডাকে।
সুমনের মা দরজা খুলে দিয়েই সুমনকে বলে খোকা তুই এখান থেকে চলে যা, কি অন্যায় করেছিস?
পুলিশ এসে অশ্রাব্য গালিগালাজ করেছে, ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে তোর বইয়ের বাক্স থেকে কি সব নিয়ে গেল। তোকে থানায় দেখা করতে বলেছে বড়বাবু।
খোকা তুই চলে যা, ওরা তোকে মারবে।
সুমন সেই রাত্রেই বাড়ি ছাড়ল। ভোরের ট্রেন ধরে সুমন। উদ্ভ্রান্ত কিন্তু কঠোর আজ সে।অনেক বেশি সচেতন। আজকে ওর লড়াই আরো অনেক অনেক মানুষের জন্য। আজ আর সুমন শুধুই নিজের কথা ভাবে না।
কয়েক মাস পর একদিন ফিরেছিল রাতের অন্ধকারে গাড়ি করে। ওর মাকে ও পৌঁছে দিয়েছে চন্দননগরে মাসির বাড়িতে। সেখানেও আজ আর মায়ের কোন অসুবিধা হয় না। মাসি ও মাসতুতো ভাইরা খুবই ভালোবাসে সুমনকে ও ওর মাকে।কিন্তু সুমনের সাথে কেবলই মোবাইল ফোনে যোগাযোগ। এটাই যন্ত্রণার, যন্ত্রনা ওর মায়েরও। তবুও সুমন আজ অনেক বড় লড়াই ছেড়ে আসতে চায় না। সুমন স্বপ্ন দেখে শোষণ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার, শ্রেণী শোষণ মুক্ত এক রাষ্ট্রের।
মাধ্যমিকে শহরের স্কুল থেকে ৮৫ শতাংশ নম্বর নিয়ে সুমন পাশ করে।
অভাবী সংসারে একমাত্র উপার্জন করেন সুমনের বাবা। সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। সুমনের ইচ্ছা বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার। কিন্তু অভাবের সংসারে ওর বাবার বিজ্ঞান নিয়ে যে পড়ানো সম্ভব নয়, তা সুমন বিলক্ষণ বোঝে। তাই বাবাকে চাপ দেয়নি।
ছেলের পড়াশুনার জন্য সুমনের মা , বাবার অমতেই রাখির কারখানায় কাজ করতে শুরু করে। স্কুলের শিক্ষকরাও চেয়েছিল সুমন বিজ্ঞান নিয়ে পড়ুক। কিন্তু তাতে রাজি করাতে পারেনি সুমনকে। তবে কলা বিভাগের শিক্ষকরা সুমনের প্রাইভেট টিউশনির টাকা কেউই নিতেন না।
অভাবের সংসারে কিছুটা সাহায্যের জন্য সুমন পাড়ারই এক ধনীর মেয়েকে পড়াতে শুরু করে।
উচ্চ মাধ্যমিক ও গ্রাজুয়েশন উভয় পরীক্ষায় সুমন প্রথম ডিভিশনে স্টার মার্ক্স নিয়ে পাশ করে।
আশালতা সুমনের ছাত্রী । সুমন এখন আর আশাকে পড়ায় না। একদিন রাস্তায় সুমনের সাথে আশার দেখা হতে, আশা জানতে চায় সুমন দা কেমন আছো? বাড়ির সকলে কেমন আছেন?
সুমন মৃদু স্বরে উত্তর দেয় ভালো ।
উত্তরটা আশার পছন্দের হলেও কেমন যেন লাগে।
আশা বলে- এত দাড়ি কেন মুখে? আগে তুমি কত সুন্দর দেখতে ছিলে। দাড়ি রেখে বিচ্ছিরি লাগছে তোমায়। প্লিজ কেটে ফেলো।
সুমনের চোখ ছলছলে, আশার দৃষ্টি এড়ায়নি।
আশা বলে কি হলো? কাঁদছো?
সুমন বলে এম এর এডমিশন । অনেকগুলি টাকার প্রয়োজন । এখনো জোগাড় হয়নি। বাবাও আর আগের মত বেতন পায় না। দোকানের মালিক বাবার বয়স হয়েছে বলে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছে।
আশার চোখে জলে ভরে যায়।
আশা বাড়ি গিয়ে মায়ের সাথে কথা বলে পরের দিন সকালে সুমনের বাড়ি যায়। ভর্তির টাকা জোগাড় হয়েছে সুমন দা। মা দিয়েছেন।
সুমন লজ্জা পায় নিতে। আশা ৫০০০ টাকা সুমনের বুক পকেটে গুঁজে দেয় একেবারে জোড় করেই প্রায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার সময় সুমন বাসের এক কোনে বসে ভাবে তার ছাত্রীর কথা। ভাবে এমনও হয়?
২০১২ সালে সুমন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়।
অভাবের সংসারে সুমনের PHD করার ইচ্ছা থাকলেও আর সম্ভব হয়নি। এখন সুমনের দরকার একটা চাকুরী। বিভিন্ন পরীক্ষায় সুমন বসে কিন্তু একটিতেও সুমন যোগ্যতা থাকলেও পাশ করতে পারে না।
ভালো ছেলে । ভালো চাকুরীর যোগ্যতা থাকলেও সুমন সেই সব চাকুরীর পরীক্ষায় পাশ করতে পারে না। এখন কম্পিটিশনের যুগ। তাই পরীক্ষায় ভাল ফল করতে গেলে শহরের নামি প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর পরীক্ষার কোচিং নিতে হয় ,সুমন জানে। কিন্তু উপায় নেই, অর্থ নেই।
রাজ্য সরকারের গ্রূপ ডি ,প্রাইমারি শিক্ষক পরীক্ষাতেও বসেছে। কিন্তু অর্থের জন্য তা আর পাওয়া হয়নি। এদিকে চোখের সামনে সুমন দেখে তারই ছাত্রী আশা প্রাইমারিতে চাকুরী পেয়েছে।মাধ্যমিকে আশা ২য় বিভাগে পাশ করেছিল। গোবলা চাকুরী পেল বিধায়কের অনুগত বলে। অথচ ওই গোবলাই মাধ্যমিকে দুইবার ফেল করেছিল ইংরেজিতে।
পাড়ায় শুনেছে, আশার বাবা ৫লক্ষ টাকা দিয়ে নাকি মেয়ের চাকুরী কিনেছে।
শহরে অনেকেরই যোগ্যতা সুমনের থেকে বেশি। সুমন চাকুরী পায়নি, অথচ আশা, গোবলারা চাকুরী করে। সুমন ভাবে এযুগে চাকুরী পাওয়াটাই তো যোগ্যতার মাপকাঠি। কে কতটা সফল তাই তো তার মাপকাঠি। সে সৎ পথে সফল না অসৎ পথে সফল আজকাল তা বিচার্য নয়। এসব ভাবতে ভাবতেই সুমনের চোখে জল আসে। তবুও সুমন শক্ত। মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়।
সুমন এখন টিউশনি পড়ায়। অভাবের সংসারে সেই একমাত্র উপায়ী। বাবা মায়ের বয়স হয়েছে। তাই সকাল থেকে সন্ধ্যা সুমনের নিত্যদিন কাটে আগামী দেশের ভবিষ্যৎ তৈরিতে।
একদিকে হতাশা অন্যদিকে সুমনের জীবনে বেঁচে থাকার লড়াই অন্যদিকে বৃদ্ধ পিতা মাতার মুখে অন্ন জোগানোর তাগিদ ,ঔষধ খরচ। ডুকরে ডুকরে কাঁদে নদীর ধারে বসে,এসমাজকে সুমন ঘৃণা করতে শুরু করে। সমাজে প্রকৃত শিক্ষার মূল্য নেই, চিকিৎসা- সেও ধনীর জন্য, মাথা গোঁজার এক চিলতে নিজেস্ব বাড়ি ও নেই সুমনদের। মাসে 3000 টাকা ঘর ভাড়া ,সংসার খরচ বহন করতে সুমনকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও রাতের পর রাত জাগতে হয়। রাত ১০ টায় বাড়ি ফিরে ও আরো দুই ঘন্টা রাখি বানায়। এরই মধ্যে বাবা সেরিব্রাল এট্যাকে মারা গেলেন। পয়সার অভাবে বাবার পারলৌকিক কাজ করতে পারেনি। যদিও ঈশ্বর ভক্তি কোন কালেই সুমনের ছিল না। সুমন ভাবত ঈশ্বর সেতো ধনীর, গরিব বুভুক্ষ মানুষকে ঈশ্বরও পছন্দ করে না। তাই সেই বা কেন ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা দেখাবে?
এদিকে মা ও অসুস্থ। সুগার, উচ্চ রক্তচাপ জনিত অসুখে দীর্ঘদিন ভুগছে। মায়ের চিকিৎসায় কোন রকম কার্পন্যতা সুমন করেনা। যদিও বাবার চিকিৎসার জন্য শেষ সময়ে অর্থ জোগাড় ও করতে পারেনি। সেই বেদনা থেকেই রক্ত জল করেও রাত্রেও সুমন রাখি বানায়। ও বুঝে যায় এই সমাজ, বঞ্চনার আসল চেহারা।
সুমন ঘৃণা করে এই সংস্কৃতিকেও। যে সংস্কৃতির আমদানি করা হয়েছে সেই ইংরেজ আমল থেকে। ওর দুঃখের কথা একমাত্র বোঝে শহরের এক দাদা। ওরা দুজনে কয়েকবার কলকাতাতেও গিয়েছিল। মিটিং করেছে কয়েকজনের সাথে। তারাও সকলেই শিক্ষিত ভদ্রলোক। ও ভালোবাসে ফেলে তাদের। ওরা সকলেই নতুন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখে। এ সমাজে গরিব শোষিত মানুষের বঞ্চনা নিয়ে আলোচনা করে।
সুমন নিজের ব্যক্তি জীবন নিয়েও তাদের সাথে চর্চায় মেতে ওঠে। কিন্তু এই ভাবেই কয়েক মাস চলতে না চলতেই একদিন সুমনের বাড়িতে পুলিশ এসে কড়া নাড়ে। সুমনের অসুস্থ মা দরজা খুলে দিতেই পুলিশ ঘরে ঢুকে পড়ে সুমনের মাকে ঠেলে। তন্ন তন্ন করে বিছানার তলায়, আলমারি, সুমনের বইয়ের ট্যাঙ্কটি ভেঙে কিছু কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করে। সুমন তখনও বাড়ি ফেরে নি।
সেদিন একটু বৃষ্টি পড়ায় সুমনের পড়াতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফেরার পথে পাড়ার এক ছোট্ট ছেলে রাস্তায় সুমনকে দাঁড় করিয়ে প্রথম পুলিশ আসার কথা বলে।
প্রথমে সুমন বিশ্বাস করেনি। পরে আরো কিছুটা আসার পর দেখে পাড়ার মোড়ে জটলা। সুমন তখনই পুরা বিষয়টি আঁচ করে। তাই বাড়ি ফিরতে একটু দেরি করে।
রাত্রি তখন ১টা। সুমন ছটফট করছে, ওর মা কি ভাবছে, কি করছে এই ভেবে। পাড়ার মোড়ে একটি জায়গায় সাইকেলটি রেখে নিঃশব্দে বাড়িতে এসে জানালা দিয়ে মাকে ডাকে।
সুমনের মা দরজা খুলে দিয়েই সুমনকে বলে খোকা তুই এখান থেকে চলে যা, কি অন্যায় করেছিস?
পুলিশ এসে অশ্রাব্য গালিগালাজ করেছে, ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে তোর বইয়ের বাক্স থেকে কি সব নিয়ে গেল। তোকে থানায় দেখা করতে বলেছে বড়বাবু।
খোকা তুই চলে যা, ওরা তোকে মারবে।
সুমন সেই রাত্রেই বাড়ি ছাড়ল। ভোরের ট্রেন ধরে সুমন। উদ্ভ্রান্ত কিন্তু কঠোর আজ সে।অনেক বেশি সচেতন। আজকে ওর লড়াই আরো অনেক অনেক মানুষের জন্য। আজ আর সুমন শুধুই নিজের কথা ভাবে না।
কয়েক মাস পর একদিন ফিরেছিল রাতের অন্ধকারে গাড়ি করে। ওর মাকে ও পৌঁছে দিয়েছে চন্দননগরে মাসির বাড়িতে। সেখানেও আজ আর মায়ের কোন অসুবিধা হয় না। মাসি ও মাসতুতো ভাইরা খুবই ভালোবাসে সুমনকে ও ওর মাকে।কিন্তু সুমনের সাথে কেবলই মোবাইল ফোনে যোগাযোগ। এটাই যন্ত্রণার, যন্ত্রনা ওর মায়েরও। তবুও সুমন আজ অনেক বড় লড়াই ছেড়ে আসতে চায় না। সুমন স্বপ্ন দেখে শোষণ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার, শ্রেণী শোষণ মুক্ত এক রাষ্ট্রের।
সমাপ্ত
--------------------