আমার চোখে মাইসোর ও উটি ....✍প্রানকৃষ্ণ মিশ্র




ভ্রমণ

আমার চোখে মাইসোর ও উটি

প্রানকৃষ্ণ মিশ্র


চিকিৎসার কারনে মাঝেমাঝেই ব্যাঙ্গালোর যেতে হয় কয়েকবছর ধরে। অথচ পাশেই মাইসোর ও উটি সময়ের কারনে যাওয়া হয়ে ওঠে না।
গতবছর ফেব্রুয়ারীতে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছেই শুনি হাসপাতাল শুক্রবার ও শনিবার বন্ধ। রবিবার এমনিতেই বন্ধ থাকেই। তাই মাইসোর ভ্রমনের সুযোগ হাতছাড়া করলাম না।
আমি ব্যাঙ্গালোরে বৃহ:স্পতিবার রাত্রে পৌঁছেছিলাম। বৃহ:স্পতিবার রাত্রে হোটেলে রাত্রিযাপন করেই, শুক্রবার সকালে তল্পিতাল্পা গুটিয়ে হাজির হলাম ব্যাঙ্গালোর সিটি স্টেশনে।
সকালের ট্রেন ধরে পৌঁছালাম মাইসোর। সময় লাগলো ৩ ঘন্টা মাইসোর পৌঁছাতে। একটি সস্তার হোটেল যোগার করে নিতে খুব অসুবিধা হলো না। ট্রেনে বসেই অনলাইনে হোটেল বুক করে ফেলেছিলাম।
আমার সহধর্মীনি ও কন্যার তো খুবই আনন্দ। চিকিৎসা করাতে এসে ভ্রমনের হাতছানি। একসাথে রথ দেখা কলা বেচা দুইই।
মাইসোর স্টেশন থেকেই একটি অটো বুক করে পৌঁছে গেলাম হোটেল ঐশ্বর্য লজে। খুব সাদামাটা হলেও বেশ সুন্দর। হোটেলের কর্মচারীদের ব্যবহারও ভালো।
হোটেলের রূমে ঢুকে স্নান ও টিফিন সেরেই সকালে বেড়িয়ে পড়লাম মাইসোর শহরের অন্যতম অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুন্ডা মায়ের মন্দিরে। পাহাড়ের উপরে চড়কি পথ অতিক্রম করে চামুন্ডা মন্দিরের অবস্থান অত্যন্ত মনোরম। মাইসোরে সরকারী বাস পরিষেবা অত্যন্ত সুন্দর। মন্দির চত্ত্বরেই বাসস্ট্যান্ড। মন্দির থেকে সমগ্র মাইসোর শহর দেখা যায়। রাত্রে তা আরো সুন্দর লাগে।
চামুন্ডা মন্দির দর্শন করে বাস ধরে আমরা এলাম মাইসোর চিড়িয়াখানায়। ৫০ টাকা প্রতি মাথাপিছু টিকিট সংগ্রহ করে চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করি। এখানে হাতি, বাইসন, জিরাফ, জেব্রা সহ বিভিন্ন পশুপাখী আছে। ভিতরে ঢুকে আপনার মনে হবে যেন আলিপুর চিড়িয়াখানায় আছেন। তবে এত বাইসন বোধহয় ভারতের অন্য কোন চিড়িয়াখানায় পাবেন না। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে। ঠান্ডার প্রকোপও বাড়ছে। তাই চিড়িয়াখানায় খুব বেশি সময় ব্যয় না করে বেড়িয়ে এলাম চিড়িয়াখানার বাইরে।
এবার গন্তব্য বৃন্দাবন গার্ডেন। বৃন্দাবন গার্ডেন মাইসোরের অন্যতম এক দর্শনীয় স্থান। এখানে অনেক চলচিত্রের শুটিং হয়। তাছাড়া বিকাল থেকেই "লাইট এন্ড স্যাডো" তার সাথে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন ফোয়ারর নাচ আপনাকে আনন্দ দেবেই। সাথে একটু সময় নিয়ে নর্মদা ব্যারেজে জলবিহার আপনাকে রোমান্টিক করে তুলবেই। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।তাই খুব বেশি রোমান্টিক হলে মাইসোর প্যালেশের আলোকসজ্জা ও সঙ্গিতানুষ্ঠান ফাঁকি পরে যাবে। তাই বাস ধরে ফিরে আসার পালা মাইসোর প্যালেসে।
সন্ধ্যা ৭ টা বাজে। মাইসোর প্যালেসের সামনে এসে মনে হচ্ছে আমরা যেন ২০০ বছর পূর্বের সময়ে পৌঁছে গেছি। মাইসোর প্যালেস এখনও রাজ পরিবারের তত্বাবধানেই আছে। সারা প্যালেস আলো ঝলমল করছে। যে দিকেই তাকাই শুধু আলো আর আলো। দূরে প্যালেসের সামনে সঙ্গীতানুষ্ঠান। এখানে প্যালেসে প্রতিদিনই সঙ্গীত অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন প্রথিতযশা শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন।প্যালেশের অভ্যন্তরে চারিদিকে হাতি ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। হাতির উপর বসে আছেন রাজ পরিবারের কর্মকর্তারা। সে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। উনবিংশ শতকের মাধুর্য।
মাইসোর প্যালেস থেকে বেড়ুলাম রাত্রি ৮ টায়। এদিকে চোখে ঘুম, পেটে ক্ষিদে। তাই ফিরে আসা হোটেলে। হোটেলে ফিরে রাত্রের খাবার খেয়ে সবে উঠেছি। হোটেল ম্যানেজার প্রস্তাব দিলেন উটি ঘুড়ে আসার। আমি জানতে চাইলাম একদিনেই কি ঘুরে আসা সম্ভব?
ম্যানেজার বললেন সকাল ৮ টার মধ্যে বেড়ুলে রাত্রি ১২ টার মধ্যে ফিরে আসা সম্ভব।জনপ্রতি ভাড়া ৫০০ টাকা। আমি রাজি হয়ে যাই।
পরের দিন সকালে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিই। সকাল ৮ টাতেই দেখি হোটেলের সামনে আমাদের গাড়ি। মোট যাত্রি ১৬ জন। এরা বিভিন্ন হোটেলের। তাই প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও মানিয়ে নিতে খুব অসুবিধা হয়নি।



বাস কিছু দূর যাবার পর একটি হোটেলে দাঁড়ায়। এখানে মাইসোর শিল্কের সাড়ির দোকান। যাত্রিরা সবাই কিছুকিছু কেনাকাটায় ব্যাস্ত। ড্রাইভারের তাড়া খেয়েই সকলে আবার যে যাঁর সিটে বসলেন। সামনেই বন্দিপুর ফরেষ্ট। প্রায় ১৫ কিমি রাস্তা এই গভীর বনের মধ্য দিয়ে ছুটতে লাগল গাড়ি। সব জানালা দরজা বন্ধ। কারন বাইসন, লেপার্ড, হাতি, হরিণের মুক্তাঞ্চল। জানালার দিকে সবাই তাকিয়ে। ক্যামেরা ঝলক বারবার।রাস্তার ধারে ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন প্রজাতির হরিন চড়ে বেড়াচ্ছে। সাথে শিশু শাবক। দূরে বাইসন শিং উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। মাঝে মাঝে বন দপ্তরের অফিস, স্থানীয় আদিবাসীদের বাড়ি। ময়ূর, বনমুরগী চোখে পড়ছে, যদিও বাঘের দেখা মেলে নি।
বন্দিপুর ফরেষ্ট পেড়িয়ে তামিলনাড়ুর আরো একটি অভয়ারন্য। তারপর পাহাড়ের পাকদন্ডি পথ। মনে হবে আপনি যেন ডুয়ার্স ছাড়িয়ে দার্জিলিং বা কালিম্পং এর পথে। এদিকে ঠান্ডাও বাড়ছে। চারিদিকে চা ও কফি বাগান। দূরে ঝরনা দেখা যায়। উটি দক্ষিনের দার্জিলিং। সত্যিই অপরূপা উটি।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এক শৈলশহর। উটি পৌঁছানোর আগে থেকেই রাস্তায় মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছিল। তাই মন আমাদের ভারাক্রান্ত।
বাস থেকে নেমেই আমরা একটা অটো ভাড়া করে পৌঁছাই যেখানে "রাজ" সিনেমার সুটিং হয়েছিল সেই জায়গায়। ঘন পাইন গাছের বন। আমরা ভয় না পেলেও আমার ৯ বছরের কন্যা সহ বাসের কচি সহযাত্রিরা ভয় পেয়েছে এই জায়গায়।
এরপর একটি কফি বাগানে যাই। কফি বাগান থেকে ফিরে আসি মাইসোর বোটানিক্যাল গার্ডেনে। বোটানিক্যাল গার্ডেনে টিকিট কেটে প্রবেশ করার পর প্রবল বৃষ্টি। আমাদের কাছে ছাতা না থাকায় সারা শরীর আমাদের ভিজে যায়, সাথে কাঁপুনি। ২ ঘন্টা পরে বৃষ্টি থামে। এই কাহিনীতে দুজন ব্যাক্তির কথা না বললে অপরাধ হবে। প্রকাশ ও তার স্ত্রী। নবদম্পতি নিজেদের ছাতার তলায় নিজেরা ভিজে আমার কন্যাকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। মানুষ আজও মানুষ আছে, সবাই অমানুষ হয়ে যায়নি। স্বার্থপরের পৃথিবী নয়, এ পৃথিবী আজো ভালোবাসা, মানবিকতা,মনুষ্যত্ব বিবর্জিত হয়ে ওঠেনি।
রাস্তায় এক হাঁটু জল।পাহাড়ি শহরে এ দৃশ্য আমার জীবনে প্রথম দেখা।উটি ভ্রমন স্বাচ্ছন্দে হলো না। ভেজা সিক্ত শরীরে ফিরে এলাম বাসে। বাসে এসে দেখি সকলেই ভিজে গেছেন। কেউ কাঁপছেন কেউ জামাকাপড় বদলিয়ে অপেক্ষায় আছেন ফিরে যাবার।
রাত্রি ১২.৩০ ফিরে এলাম মাইসোর শহরে। প্রত্যেক বাসযাত্রীকে তাঁদের নির্দিষ্ট হোটেলে নামিয়ে ড্রাইভার সব শেষে আমাদের নামালেন হোটেলের সামনে। উটি ভ্রমন স্বার্থক হলো না। কিন্তু মনের মণিকোটায় স্থান পেয়ে থাকবে বাকি জীবনে।

কি ভাবে যাবেন:- হাওড়া থেকে মাইসোর এক্সপ্রেস। ব্যাঙ্গালোরগামী যে কোন ট্রেন ধরে ব্যাঙ্গালোর স্টেশনে নেমে বিভিন্ন শেয়ার ট্যাক্সি বা বাস পাবেন। ব্যাঙ্গালোর থেকে ৩ ঘন্টার রাস্তা মাইসোর।
দর্শনীয় স্থান: - মাইসোর প্যালেস, বৃন্দাবন গার্ডেন, চামুন্ডা মন্দির, শ্রীরঙ্গপত্তনম, টিপু সুলতান প্যালেস, মাইসোর চিড়িয়াখানা সহ এক সুন্দর ঐতিহাসিক শহরের বিভিন্ন নিদর্শন ও উটি শৈল শহর।

আনুমানিক খরচ:- জন প্রতি ৫০০০ টাকা

প্রানকৃষ্ণ মিশ্র
8145531321

সমাপ্ত
--------------------
ভাষাপথ অ্যাপটি ব্যবহার করবার জন্য ধন্যবাদ। এই অ্যাপটি ভালো লাগেল, অবশ্যই ফাইব ষ্টার রেট দেবেন এবং কমেন্ট করে আপনাদের মতামত জানাবেন এবং সকলের সাথে শেয়ার করে নেবেন।