তোমারই মাটির কন্যা ....✍সিদ্ধার্থ মুখার্জি




গল্প

তোমারই মাটির কন্যা

সিদ্ধার্থ মুখার্জি


সে কবেকার কথা!
১৯৮০-৮১ হবে। তখন নভেম্বর মাসের শুরুতে কলকাতায় ঠান্ডা পড়ত...জুসলা-ভিমটো-ক্যাম্পাকোলার দোকানে এক্সপ্রেসো কফির ঢাউস মেশিন বসে যেত আর আমরা ট্রামে ঝুলতে ঝুলতে মেডিক্যাল কলেজ যেতাম। সে অনেকদিনের কথা!

শীত শুরুর এরকম এক রাত্তিরে আমাদের Labour Room ডিউটি চলছে। অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের ভীড় আর ব্যথিত কন্ঠের কলরব
"গর্ভগৃহ " কে সরগরম করে রেখেছে।

সকলের মধ্যে থেকেও বড্ড শান্ত আছেন এক জন মহিলা -- কৌতুহল আর যেন ঈষৎ কৌতুক
মেশানো দুটি দীঘল চোখে পরিস্থিতি অনুসরণ করে চলেছেন সেই তরুণী মা !

কাছে গিয়ে ফাইল টা দেখলাম : বকুল বিবি - ২৬ বছর - স্বামী : বসির আলী - ঠিকানা : গ্যালিফ স্ট্রীট।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম : ভয় পাচ্ছেন না... আর সবাইয়ের মতো? এতো শান্ত আছেন ! :
ভারি ম্লান হেসেছিল সেই মেয়ে:
ডাক্তারবাবু, দেগঙ্গা থেকে বিয়ে হয়ে এই শহরে এসেছি পাঁচ বছর। বাচ্চা এলোনা ব'লে স্বামী -শাশুড়ি সব্বাই কত অপমান করেছে রোজ! এই ব্যথা তো কিচ্ছু নয় তার পাশে। আর... ভয় কেন পাব? এতো বড় হাসপাতাল - এতো নার্স দিদি ডাক্তারবাবু রয়েছেন সবাই....!

জানেন, বেশ অবাক হয়েছিলাম তার কথা শুনে... প্রত্যয় দেখে।
****
এক সময় তার "ডেলিভারি" হলো। আমার হাত ধরেই তার সন্তান এলো কলকাতায়।
বকুল কিন্তু আগাগোড়া চোখ বন্ধ ক'রে কিছু একটা আবৃত্তি... না কি স্তবগান করে গ্যালো।
নার্স এসে একসময় তাকে বেশ কর্কশ ভাবেই বললো:
এই যে বকুল বিবি তোমার বাচ্চা। :
আধবোজা চোখে সে জিজ্ঞাস করলো:
আমার বাচ্চা সুস্থ আছে তো? :
আমিই উত্তর দিয়েছিলাম:
তা আছে। আপনার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে না.. কি হয়েছে ?
কি চেয়েছিলেন... ছেলে না মেয়ে? :
: একটা সুস্থ বাচ্চা চেয়েছিলাম ডাক্তারবাবু । নিজে তাকে পড়াতে পারবো... মানুষ করতে পারবো ভাল ক'রে। ব্যস ! আমার কাছে ছেলে না মেয়ে --ওসবে কিচ্ছু যায় আসে না । :

নার্স ততক্ষণে অধৈর্য হয়ে উঠেছে
: বড্ড পটর-পটর লেকচার মারছো যে ! আজকে এখানে লাইন দিয়ে ছেলে হয়েছে... দশটা! একমাত্র তোমার মেয়ে। বাড়িতে যাও না! দেখবে কেমন সোনার হার দিয়ে মুখ দেখে ! :

বকুল চোখ খুলে তাকালেন। এক ফোঁটা জল তার দীঘল চোখের ঘাটে।
চোখের সামনে ফ্যাকাসে লাল কাপড়ে মোড়া গোলাপী রঙের একটি মুখ। হাতটা বাড়িয়ে শিশুটির একটা আবছা অবয়ব আঁকলেন যেন।
আমি যেতে গিয়েও একটু দাঁড়ালাম।
: ডেলিভারির সময় কি কোন মন্ত্র পড়েছিলেন ? :
এবার সদ্য মা হওয়া তরুণী টি কিশোরীর লজ্জা চোখে নিয়ে হাসলো, প্রথমবার।
: না, না... আমি একটা গান গাইছিলাম... আমার ভীষণ ভাল লাগে ওই গানটা। :
: গান... লেবার রুমে !
(শহুরে ডাক্তারের খুব হাসি পেয়েছিল,জানেন ... )
কি গান গাইলেন ? :
এবার বছর ছাব্বিশের সাদামাটা মেয়েটি যেন সংকুচিত হলো একটু।
আস্তে... খুব আস্তে উচ্চারণ করলো
: রবীন্দ্রনাথের গান। সেই যে চিত্রলেখা চৌধুরী গেয়েছিলেন --
তোমারই মাটির কন্যা !
আমি টেপ বাজিয়ে শুনি প্রায়ই। :

এত বড় ঝাপটা সামলাতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লাগে। লেগেওছিল।
চিত্রলেখা চৌধুরী -- অ্যামেরিকা প্রবাসী পদার্থবিদ্যার সেই অধ্যাপিকার অসাধারণ সেই গান... এখন তো ছেড়েই দিন, তখনো খুব বেশি শ্রোতা নেন নি।

বকুলের কপালে হাত বুলিয়ে শুধু বলতে পেরেছিলাম
: বাহ ! মেয়ের যত্ন করবেন। নিজেও সুস্থ থাকবেন। :
*****
মাসখানেক প'রে... মেয়েকে BCG টিকে দিয়ে ফেরার পথে আমাদের ডিপার্টমেন্টের OPD তে এসে উপস্থিত বকুল।
রুটিন চেক আপ। আমি সেদিন ছিলাম। ভালোই আছে মোটের ওপর। প্রশ্ন করলাম
: মেয়ের বাবা এলোনা সঙ্গে? :
: নাহ । তার রঙের কাজ... ছুটি নেই। তাছাড়া... ছেলে হলেও নাহয়... কেন, আমি আসলে হবে না ডাক্তারবাবু ? :
প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম
: মেয়ের নাম কি রাখলেন? :
: এখনো রাখিনি সে ভাবে। আপনিই একটা নাম বলুন না... সবাই খেঁদি...পেঁচি এই সব বলে। ভাল লাগে না আমার। দিন না একটা নাম ব'লে। :

কেন জানি না, সেদিন ' না ' বলতে পারিনি। খুব সিরিয়াসলি না হলেও বলেছিলাম
: কেন আপনার সেই গানের কথাতেই তো নাম দিয়েছেন রবিঠাকুর। মৃত্তিকা! :

সেই দীঘল চোখের ঘাটে সেদিন জ্বলে উঠতে দেখেছিলাম এক অদ্ভুত আনন্দ আর অহংকারের আলো। বকুল বিবি সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন
: ডাক্তারবাবু , আমি যদি বেঁচে থাকি... মৃত্তিকাকে মানুষ করবোই... দেখবেন ওকে WBCS বানাবো ! আরো অনেক বাড়িতে কাজ নিয়ে আমি পড়াবোই !
আমাকে বাবা কলেজে পড়তে দিলো না... মেয়েকে আমি ইনভার্সিটিতে পড়াবোই পড়াবো! দেখবেন। :
পরিস্থিতি হাল্কা করার জন্য বলেছিলাম
: বেশ তো, মেয়ে একটার পর একটা পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করবে আর আপনিও এসে আমাদের মিষ্টি খাইয়ে যাবেন না হয়... :

একমাসের কালোকুলো মেয়েটি তখন নিশ্চিন্তে নিদ্রামগ্ন।

কয়েক মাস পরে আমার সরকারি হাসপাতালের মেয়াদ ফুরোলো।
মৃত্তিকার গল্পের নটে শাকটি ও মুড়োলো।

*****

এবার জাম্প কাট - ২০১৫ - বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘের পূজো মন্ডপ। বিরাট ভীড়ের মধ্যে হঠাৎ আবিস্কার করলাম আমার এক সহপাঠীকে।
তিনি হেলথ সার্ভিসে রয়ে গিয়েছেন। আমাদের সেই হাসপাতালের Gynaecology - Obstetrics এর অধ্যাপক বেশ কিছুদিন যাবত। পুরোনো কথা আর চা একসাথে চলছিল। হঠাৎ ভারি অদ্ভুত একটা কথা বললো সে।
: আরে, আমরা তো বছর বছর তোর নামে পাঠানো মিষ্টি খাই। এক মহিলা, কবে যেন একদিন ক'রে এসে তার মেয়ের জন্মদিনের মিষ্টি দিয়ে যায়.... তুই নেই শুনে, যারা ও পি ডি তে থাকে তাদেরই বলে মেয়েকে আশীর্বাদ করতে। আরো ভাল রেজাল্ট করে যেন। কি গ‍্যাঁড়াকল বলতো ? :

একটা শ্রদ্ধাবোধ আমায় একটু একটু করে আচ্ছন্ন করছিল। তার মাঝেই শুনলাম সতীর্থর কন্ঠ
: আরে গতবছর তো আরেক কান্ড ! একটা লালবাতি স্করপিয়ো এসে থামলো...উর্দি পরা সান্ত্রী পেয়াদা সঙ্গে নিয়ে একটা ইয়ং মেয়ে সটান ঢুকে পড়ল আমার ঘরে... কি যেন নাম বললো... SDO পোস্টে আছে। তার মা অসুস্থ... সেই মিষ্টি এনেছে... জন্মদিন বলতে লজ্জা পেল বোধহয়! তিন চার হাঁড়ি দ্বারিকের রসগোল্লা ! ইশশ... এতোদিনের জমানো thanks তোকে দেওয়ার আছে রে ! :
****
এবার যেন তিনি সুস্থ থাকেন।
হয়ত মেয়ের হাত ধরেই গাড়ি থেকে নেমে আসবেন... চশমার পিছনে দীঘল চোখের ঘাটে ঝিকমিক করবে এক ফোঁটা আনন্দাশ্রু... সঙ্গের আর্দালি র হাতে মিষ্টি.... বকুল মা ।

( তোমারই মাটির কন্যা :
" দ্রিঘাংচুর দিগ্ দর্শন" প্রথম খন্ড)

সমাপ্ত
--------------------
ভাষাপথ অ্যাপটি ব্যবহার করবার জন্য ধন্যবাদ। এই অ্যাপটি ভালো লাগেল, অবশ্যই ফাইব ষ্টার রেট দেবেন এবং কমেন্ট করে আপনাদের মতামত জানাবেন এবং সকলের সাথে শেয়ার করে নেবেন।