স্বপ্ন কি সত্যি হয় ....✍আত্রেয়ী আঢ্য
গল্প
স্বপ্ন কি সত্যি হয়
আত্রেয়ী আঢ্য
ধবধবে সাদা রঙের ফুল স্লিভ ফ্রিল্ দেয়া লং ফ্রকটা পড়ে তিন্নি ওর মায়ের সাথে ভিক্টোরিয়ায় বেড়াতে এসেছে । একটা ঘোড়ার গাড়ি দেখে ওটাতে চাপবে বলে ও মায়ের আঁচল ধরে প্রায় টানাটানি শুরু করে দিল । ওর অনেকদিনের সখ ঘোড়ার গাড়ি চড়বে । ঘোড়াটা ওর ফ্রকটার মতোই সাদা ধবধবে । তিন্নির মা ওর জেদ সামলাতে না পেরে গাড়ির সামনে এলো । হঠাৎ তিন্নির মনে হলো , মা এমন একটা ছেঁড়া শাড়ি পরে বেড়াতে এসেছে কেন ? ও তো নিজে কত সেজেছে ! মাথায় ফুল দেয়া হেয়ার ব্যান্ড , হাতে চুড়ি , পায়ে সাদা জুতো ! আর না ভেবে তিন্নি গাড়িতে উঠতে গিয়ে একটা পেরেকে খোঁচা লেগে ওর খুব পছন্দের ফ্রকটার নিচের অংশ অনেকটা ছিঁড়ে গেলো । মাকে না নিয়েই ঘোড়ার গাড়িটা দৌড়াচ্ছে খুব জোরে । তিন্নি খুব কাঁদছে । ভয়ে , দুঃখে ও কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে । শরীরটা মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে । চোখ খুললো তিন্নি । একটা আবছা সরু আলোর রেখা বন্ধ জানালার চিলতে ফাঁক গলে ঘরে ঢুকছে । তিন্নি বুঝলো , ও স্বপ্ন দেখছিল ।
লাইনের ধারের ঘিঞ্জি বস্তিতে একটা ছোট্ট মাথা গোঁজার জায়গা ।ভাঙা টালির চাল দেওয়া মাটির কুঁড়ে ঘরে সূর্য্যের আলো প্রায় আসেনা বললেই চলে । বৃষ্টি হলে ঘরের কোন কোনায় গিয়ে আশ্রয় নিলে শরীরের শতচ্ছিন্ন একফালি আবরণকে ভেজার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে তাই ভেবে কুল পায়না দশ বছরের তিন্নি আর ওর মা । ওই বস্তির আর সকলের মতোই শুধু দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছে ওরা প্রতিনিয়ত । তিন্নির মা ছায়া ঘরে বসে একটু আধটু সেলাই করে মেশিনে । ওটাই ওর একমাত্র সম্বল । মেশিনে ওর দক্ষতাও সামান্য । তাই বড়সড় কাজ পায়না কখনো । দু একটা বাড়িতে অবশ্য ঠিকে কাজ করে ছায়া । কিন্তু পরিশ্রমের পারিশ্রমিক যে বড্ড কম । মাঝে মধ্যে খবরের কাগজের ঠোঙ্গা তৈরী করে বিক্রি করে । এই যৎসামান্য আয়ে এক বা দেড় বেলা ফেনা ভাত জোটে কোনমতে । এক আধ দিন হয়তো সব্জি ভাত জোটে । কাজের বাড়ি থেকে বেচে যাওয়া বাসি তরকারী পায় অনেক সময় । তবে তা বাড়িতে আনতে আনতেই নষ্ট হয়ে যায় । বেঁচে থাকার প্রবল লড়াই মাত্র দশ বছরের ছোট্ট তিন্নিকে অনেক পরিণত করে তুলেছে । মায়ের কষ্ট দেখতে পারেনা তিন্নি । মাকে সাহায্য করার জন্যে তাই কয়েকদিন ধরে বড় রাস্তার ধারের শপিং মলটার কাছে দুচার রকমের সবজি নিয়ে বসছে ।বড্ড রোগা তিন্নি । অপুষ্টিতে ভুগছে ।অনেক আগে তিন্নির বাবা বাদল বেঁচে থাকতে ওকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । মাঝে মাঝেই ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে । কেমন ঠান্ডা হয়ে যায় । ডাক্তার ওকে রোজ একটা করে মোসাম্বি খেতে বলেছিলেন । কিন্তু সংসারের যা দুরবস্থা তাতে দুবেলা ভালো করে খাবারই জোটে না তো মোসাম্বি খাওয়া তো ওদের কাছে বিলাসিতা । ছায়া প্রায় অপারগ হয়েই তিন্নিকে কাজে নামিয়েছে ।
বাদল বেঁচে থাকতে অন্তত দু বেলা দুমুঠো খাবার নির্ভাবনায় জুটে যেত। ভালোই সেলাই জানত বাদল । হঠাৎ করেই ডেঙ্গু হয়ে মারা গেলো । তারপর থেকে ছোট্ট তিন্নিকে নিয়ে প্রায় পথে বসেছিল ছায়া । বাদল একটু আধটু পড়াশোনা জানত । মেয়েকেও দুচারটে বই কিনে দিয়েছিল । নিজেই যা পারত শেখাত । বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তিন্নির আর পড়াশোনা হয়না ।রোজ কাকভোরে উঠে তিন্নি কিছুটা লঙ্কা , দু তিন আঁটি কলমি শাক , একটু নিমপাতা , এক আধটা কাঁচকলা , পাতিলেবু এইসব নিয়ে বসে পড়ে ওই শপিং মলের সামনে । বেশি ভারী বইতে পারেনা ও । এইটুকু নিয়ে যেতেই ওর কাঠির মতো হাতদুটো ব্যথায় খসে পড়ে যায় কাঁধ থেকে ।
বিক্রি কোনদিন হয় আবার কোনদিন হয়না । তিন্নি উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে শপিং মলের সাজানো জামা কাপড়ের দোকানটার দিকে । একটা ওর মতো হাইটের পুতুলকে একটা সাদা লং ফ্রক পড়ানো আছে । পায়ে সাদা জুতো , মাথায় সাদা ফুল দেয়া হেয়ার ব্যান্ড । তিন্নির ওই পোশাকটা খুব পছন্দ । তাই মাঝে মাঝেই রাতে স্বপ্ন দেখে , ওই পোশাকটা পড়ে ও বেড়াতে বেড়িয়েছে । তিন্নির কাছে রোজ সুমি দিদি আসে । একটা লাল গাড়ি চেপে । সুমি দিদিকে দেখতে কি সুন্দর ! সুমি তিন্নির কাছ থেকে কিছু না কিনলেও ওকে রোজ পঞ্চাশ টাকা করে দিয়ে যায় । তিন্নি এমনি এমনি নিতে চায় না । তবু জোর করে দিয়ে যায় । এই কদিনে সুমিকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে তিন্নি । সুমি দিদি আর সবার মতো নয় । অন্য লোকেরা ওর সাথে খুব খারাপ করে কথা বলে । যেন ও মানুষই নয় । কিন্তু সুমি দিদির কথায় কেমন একটা মায়ার সুর থাকে । সুমি দিদির কথা তিন্নি ওর মাকেও বলেছে । মা বলে , বড় লোকদের অনেক অহংকার থাকে , পয়সার গরম থাকে । বাইরে একরকম আর ভিতরে অন্যরকম । কিন্তু মা তো সুমি দিদিকে দেখেনি তাই এমন বলে ।
সুমি খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে । অনেক টাকা পয়সা ওদের । কিন্তু তবুও খুব মাটির মানুষ । সুমিদের অবস্থা প্রথম থেকেই এমন ছিলো না । ওর বাবাকে সাংঘাতিক স্ট্রাগল করতে হয়েছে । শূন্য থেকে শুরু করে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে । অনেক ছোট থেকেই সুমি বাবার এই জীবন যুদ্ধের কথা বাবার মুখ থেকেই শুনে আসছে । ওদের এমনও দিন নাকি গিয়েছে যে ধার করে সংসার চালাতে হয়েছে । তবে সুমির গায়ে কোনো কষ্টের আঁচ লাগতে দেয় নি ওর বাবা । তাই ছেলেবেলা থেকেই সুমি খুব সেনসিটিভ । গরীব মানুষ দেখলে ওর বুকের ভিতরটা মুচড়ে ওঠে । যাকে যেমন ভাবে পারে সাহায্য করে । ওর খুব ইচ্ছে পড়াশোনা শেষ করে একটা এন জি ও এর সাথে যুক্ত হওয়া যারা এইসব অসহায় মানুষদের পাশে এসে দাঁড়ায় । তিন্নির প্রতি ওর একটা আলাদা টান জন্মে গেছে । তিন্নির মুখটা ভারী মিষ্টি । মাঝে মাঝে সুমির খুব কান্না পায় । তিন্নির মতোই আরো কত শিশু এভাবে কষ্টে বেঁচে থাকে । সুমি কলেজ যাবার পথে তিন্নির সাথে একটু গল্প করে যায় । তিন্নি ওকে কতবার বলেছে , ' ওই লাইনের ধারের বস্তিতেই আমাদের বাড়ি । চলো না সুমি দিদি ! মায়ের সাথে তোমাকে আলাপ করিয়ে দেবো ' ! কিন্তু যাওয়া হয়নি কখনো । সুমি তিন্নির সাথে গল্প করতে করতেই খেয়াল করেছে যে ও মাঝে মাঝেই কেমন উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে শপিং মলের ওই পুতুলটার দিকে । ওর টানা টানা চোখগুলো তখন আরো উজ্জ্বল লাগে ।
পুজোর মাত্র আর সাতদিন বাকি । সেদিন তিন্নি রোজকার মতোই সকালে উঠে পড়েছে । এবার যেতে হবে সব্জি বেচতে । কানে মহালয়ার গান ভেসে এলো । দূরে নবারুন সংঘের ক্লাব থেকে মাইকে মহালয়া চালিয়েছে । তিন্নি মহালয়া কি জানে । বাবা বলেছিল । মাকে ডেকে ও বলল , ' মা পুজোর আর সাতদিন বাকি । পুজোতে সবাই নতুন জামা পড়ে তাই না মা ' ? ছায়া তিন্নির কথা শুনে বলল , ' খাওয়া জোটে না যাদের , তাদের আবার নতুন জামা ' ! তিন্নিও জানে সে কথা । তবু মাঝে মাঝে ওর ছোট্ট মনটা যে মনে মনেই অনেক কিছু আবদার করে ফেলে । তিন্নি চলে গেলো নিজের কাজে ।
কয়েকদিন ধরে সুমি দিদি আসেনা । কিজানি , অসুখ করলো নাকি ? সুমি দিদির বাড়িও তো তিন্নি চেনেনা যে খোঁজ নিতে যাবে । সুমি দিদি না আসলে ওর মনটা খারাপ লাগে । মা ছাড়া ওই সুমি দিদিই তো একমাত্র মানুষ যে ওকে ভালোবাসে । বাড়ির ঠিকানা জানা থাকলে হয়তো চলেই যেত সুমি দিদির বাড়ি । কাল পঞ্চমী । শপিং মলটা কি সুন্দর করে আলো দিয়ে সাজিয়েছে । আবছা বিকেলেই সব আলো জ্বলে উঠেছে । রাস্তাতেও আলোর রোশনাই । কাছেই নবারুন সংঘে একটা বড় পুজো হয় । চারিদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ শপিং মলের ওই দোকানটার দিকে চোখ পড়ল তিন্নির । খুব বিষন্ন হয়ে গেলো ওর মুখটা । চোখটা জলে ভিজে চিকচিক করে উঠলো । ওর হরিণের মতো টানা টানা চোখে যেন আলোর প্রতিফলন হচ্ছে । তিন্নির খুব পছন্দের লং ফ্রকটা ওই পুতুলটার গায়ে আর নেই । ওই পুতুলটা আজ নতুন জামা পড়েছে । কেউ হয়তো কিনে নিয়েছে ফ্রকটা । তিন্নি আর কখনো স্বপ্ন দেখবে না । মাথা নিচু করে ও ওর বেচে যাওয়া সব্জির ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে এগোলো । হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন ডাকছে , ' তিন্নি , অ্যাই তিন্নি , দাঁড়া ' । আরে এতো সুমি দিদির গলার আওয়াজ ! ও ঘুড়ে তাকালো । আজকে সুমি দিদি একটা শাড়ী পড়েছে । তিন্নি ছুটে চলে গেলো ওর কাছে । কিন্তু সুমি দিদির সঙ্গে ওটা কে ? তিন্নিকে ইতস্ততঃ করতে দেখে প্রবাল নিজেই এগিয়ে এসে বলল , ' আমি তোমার সুমি দিদির বন্ধু । আর তোমারও নতুন বন্ধু । তুমি আমাকে চেনো না । কিন্তু আমি তোমাকে খুব ভালো চিনি । সুমি প্রায় সারাদিন আমার কাছে তোমার গল্পই করে । আজকে তাই তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চলে এলাম । আমার বন্ধু হবে ' ? তিন্নি লাজুক লাজুক হেসে মাথা নাড়ল । তারপর সুমিকে বলল , ' তুমি আসোনি কেন এতদিন ? তোমাকে না দেখলে আমার ভালো লাগে না ' । সুমি বলল , ' বাবার শরীরটা ভালো ছিলো না রে ! তাই কলেজ যেতে পারিনি , আর তোর সাথেও দেখা হয়নি ' । তিন্নি বলল , ' আমি যাই সুমি দিদি । মা চিন্তা করবে ' । সুমি তিন্নির হাতটা ধরে ওর হাতে দুটো প্যাকেট দিয়ে বলল , ' তিন্নি এটা তোর পুজোর উপহার । তোর মায়ের জন্যেও আছে ' । তিন্নি বলল , ' কি আছে গো ' ? সুমি বলল , ' দুটো জামা তোর জন্যে আর দুটো শাড়ি তোর মায়ের জন্যে ' । তিন্নি আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল , ' নতুন জামা ? কি মজা ! কি মজা ! এবার পুজোয় আমিও নতুন জামা পড়বো ' ! বলতে বলতে দুবার পা তুলে নেচে নিল তিন্নি । তারপর হঠাৎ মুখটা করুণ করে বলল , ' মা যদি বকে ? মা তো কারো কাছ থেকে এমনি এমনি কিছু নিতে বারণ করে ' । সুমি বলল , ' বকবে না । তোর মা তো জানে আমার কথা ' । তিন্নি বলল , ' হ্যাঁ তাই তো ! তুমি দিলে কিছু বলবে না ' । ওর চোখে মুখে মিলিয়ে যাওয়া আনন্দটা আবার ফিরে এলো । প্রায় নাচতে নাচতে ও বাড়ি এলো । সুমি তিন্নির আনন্দটা উপভোগ করছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে । দারুণ প্রশান্তিতে ওর মন ভরে উঠছিল । সারা পৃথিবীর দুঃখ দূর করার সাধ্য ওর নেই , কিন্তু একজনের মুখে তো ও হাসি ফোটাতে পেরেছে ! জীবনে অনেক ভাবে সুমি আনন্দ পেয়েছে । কিন্তু এই আনন্দ যেন সব কিছুকে ছাপিয়ে গেলো । সুমি প্রবালকে বলল , ' বাড়ি গিয়ে তিন্নি যখন প্যাকেট খুলবে , কত আনন্দ পাবে ও বল ' ! প্রবাল সুমির মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল ।
তিন্নি বাড়ি এসে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল , ' মা পুজোয় নতুন জামা পড়বো ! তুমিও নতুন শাড়ি পড়বে । সুমি দিদি দিয়েছে । দুটো করে দিয়েছে জানো ? তোমাকে বলেছিলাম না , সুমি দিদি খুব ভালো ' ! ছায়া মেয়ের চোখে এত আনন্দ অনেকদিন পর দেখল । ওর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো । মনে মনেই প্রান ভরে আশীর্বাদ করলো সুমিকে । তিন্নি প্যাকেট খুলে মায়ের শাড়িগুলো দিলো । নিজেরটাও দেখল । কি সুন্দর জামাটা ! দ্বিতীয় প্যাকেটটা খুলে ও অবাক হয়ে গেলো ! আরে ! এটা তো সেই শপিং মলের সাদা লং ফ্রক টা ! সাথে সাদা জুতোটাও আছে । তিন্নি খুশিতে পাগল হয়ে গেলো । ফ্রকটা পড়ে নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো , আমি আর স্বপ্ন দেখবো না মা ! এটা তো স্বপ্ন না ! একদম সত্যি ! একদম সত্যি ! ছায়া ওর কথা বুঝতে পারলো না ঠিকই , কিন্তু মেয়ের এই উচ্ছ্বাস দেখে ওর চোখের জল বাঁধ মানলো না , ভিজিয়ে দিলো ওর গালদুটো ।
লাইনের ধারের ঘিঞ্জি বস্তিতে একটা ছোট্ট মাথা গোঁজার জায়গা ।ভাঙা টালির চাল দেওয়া মাটির কুঁড়ে ঘরে সূর্য্যের আলো প্রায় আসেনা বললেই চলে । বৃষ্টি হলে ঘরের কোন কোনায় গিয়ে আশ্রয় নিলে শরীরের শতচ্ছিন্ন একফালি আবরণকে ভেজার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে তাই ভেবে কুল পায়না দশ বছরের তিন্নি আর ওর মা । ওই বস্তির আর সকলের মতোই শুধু দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছে ওরা প্রতিনিয়ত । তিন্নির মা ছায়া ঘরে বসে একটু আধটু সেলাই করে মেশিনে । ওটাই ওর একমাত্র সম্বল । মেশিনে ওর দক্ষতাও সামান্য । তাই বড়সড় কাজ পায়না কখনো । দু একটা বাড়িতে অবশ্য ঠিকে কাজ করে ছায়া । কিন্তু পরিশ্রমের পারিশ্রমিক যে বড্ড কম । মাঝে মধ্যে খবরের কাগজের ঠোঙ্গা তৈরী করে বিক্রি করে । এই যৎসামান্য আয়ে এক বা দেড় বেলা ফেনা ভাত জোটে কোনমতে । এক আধ দিন হয়তো সব্জি ভাত জোটে । কাজের বাড়ি থেকে বেচে যাওয়া বাসি তরকারী পায় অনেক সময় । তবে তা বাড়িতে আনতে আনতেই নষ্ট হয়ে যায় । বেঁচে থাকার প্রবল লড়াই মাত্র দশ বছরের ছোট্ট তিন্নিকে অনেক পরিণত করে তুলেছে । মায়ের কষ্ট দেখতে পারেনা তিন্নি । মাকে সাহায্য করার জন্যে তাই কয়েকদিন ধরে বড় রাস্তার ধারের শপিং মলটার কাছে দুচার রকমের সবজি নিয়ে বসছে ।বড্ড রোগা তিন্নি । অপুষ্টিতে ভুগছে ।অনেক আগে তিন্নির বাবা বাদল বেঁচে থাকতে ওকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । মাঝে মাঝেই ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে । কেমন ঠান্ডা হয়ে যায় । ডাক্তার ওকে রোজ একটা করে মোসাম্বি খেতে বলেছিলেন । কিন্তু সংসারের যা দুরবস্থা তাতে দুবেলা ভালো করে খাবারই জোটে না তো মোসাম্বি খাওয়া তো ওদের কাছে বিলাসিতা । ছায়া প্রায় অপারগ হয়েই তিন্নিকে কাজে নামিয়েছে ।
বাদল বেঁচে থাকতে অন্তত দু বেলা দুমুঠো খাবার নির্ভাবনায় জুটে যেত। ভালোই সেলাই জানত বাদল । হঠাৎ করেই ডেঙ্গু হয়ে মারা গেলো । তারপর থেকে ছোট্ট তিন্নিকে নিয়ে প্রায় পথে বসেছিল ছায়া । বাদল একটু আধটু পড়াশোনা জানত । মেয়েকেও দুচারটে বই কিনে দিয়েছিল । নিজেই যা পারত শেখাত । বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তিন্নির আর পড়াশোনা হয়না ।রোজ কাকভোরে উঠে তিন্নি কিছুটা লঙ্কা , দু তিন আঁটি কলমি শাক , একটু নিমপাতা , এক আধটা কাঁচকলা , পাতিলেবু এইসব নিয়ে বসে পড়ে ওই শপিং মলের সামনে । বেশি ভারী বইতে পারেনা ও । এইটুকু নিয়ে যেতেই ওর কাঠির মতো হাতদুটো ব্যথায় খসে পড়ে যায় কাঁধ থেকে ।
বিক্রি কোনদিন হয় আবার কোনদিন হয়না । তিন্নি উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে শপিং মলের সাজানো জামা কাপড়ের দোকানটার দিকে । একটা ওর মতো হাইটের পুতুলকে একটা সাদা লং ফ্রক পড়ানো আছে । পায়ে সাদা জুতো , মাথায় সাদা ফুল দেয়া হেয়ার ব্যান্ড । তিন্নির ওই পোশাকটা খুব পছন্দ । তাই মাঝে মাঝেই রাতে স্বপ্ন দেখে , ওই পোশাকটা পড়ে ও বেড়াতে বেড়িয়েছে । তিন্নির কাছে রোজ সুমি দিদি আসে । একটা লাল গাড়ি চেপে । সুমি দিদিকে দেখতে কি সুন্দর ! সুমি তিন্নির কাছ থেকে কিছু না কিনলেও ওকে রোজ পঞ্চাশ টাকা করে দিয়ে যায় । তিন্নি এমনি এমনি নিতে চায় না । তবু জোর করে দিয়ে যায় । এই কদিনে সুমিকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে তিন্নি । সুমি দিদি আর সবার মতো নয় । অন্য লোকেরা ওর সাথে খুব খারাপ করে কথা বলে । যেন ও মানুষই নয় । কিন্তু সুমি দিদির কথায় কেমন একটা মায়ার সুর থাকে । সুমি দিদির কথা তিন্নি ওর মাকেও বলেছে । মা বলে , বড় লোকদের অনেক অহংকার থাকে , পয়সার গরম থাকে । বাইরে একরকম আর ভিতরে অন্যরকম । কিন্তু মা তো সুমি দিদিকে দেখেনি তাই এমন বলে ।
সুমি খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে । অনেক টাকা পয়সা ওদের । কিন্তু তবুও খুব মাটির মানুষ । সুমিদের অবস্থা প্রথম থেকেই এমন ছিলো না । ওর বাবাকে সাংঘাতিক স্ট্রাগল করতে হয়েছে । শূন্য থেকে শুরু করে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে । অনেক ছোট থেকেই সুমি বাবার এই জীবন যুদ্ধের কথা বাবার মুখ থেকেই শুনে আসছে । ওদের এমনও দিন নাকি গিয়েছে যে ধার করে সংসার চালাতে হয়েছে । তবে সুমির গায়ে কোনো কষ্টের আঁচ লাগতে দেয় নি ওর বাবা । তাই ছেলেবেলা থেকেই সুমি খুব সেনসিটিভ । গরীব মানুষ দেখলে ওর বুকের ভিতরটা মুচড়ে ওঠে । যাকে যেমন ভাবে পারে সাহায্য করে । ওর খুব ইচ্ছে পড়াশোনা শেষ করে একটা এন জি ও এর সাথে যুক্ত হওয়া যারা এইসব অসহায় মানুষদের পাশে এসে দাঁড়ায় । তিন্নির প্রতি ওর একটা আলাদা টান জন্মে গেছে । তিন্নির মুখটা ভারী মিষ্টি । মাঝে মাঝে সুমির খুব কান্না পায় । তিন্নির মতোই আরো কত শিশু এভাবে কষ্টে বেঁচে থাকে । সুমি কলেজ যাবার পথে তিন্নির সাথে একটু গল্প করে যায় । তিন্নি ওকে কতবার বলেছে , ' ওই লাইনের ধারের বস্তিতেই আমাদের বাড়ি । চলো না সুমি দিদি ! মায়ের সাথে তোমাকে আলাপ করিয়ে দেবো ' ! কিন্তু যাওয়া হয়নি কখনো । সুমি তিন্নির সাথে গল্প করতে করতেই খেয়াল করেছে যে ও মাঝে মাঝেই কেমন উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে শপিং মলের ওই পুতুলটার দিকে । ওর টানা টানা চোখগুলো তখন আরো উজ্জ্বল লাগে ।
পুজোর মাত্র আর সাতদিন বাকি । সেদিন তিন্নি রোজকার মতোই সকালে উঠে পড়েছে । এবার যেতে হবে সব্জি বেচতে । কানে মহালয়ার গান ভেসে এলো । দূরে নবারুন সংঘের ক্লাব থেকে মাইকে মহালয়া চালিয়েছে । তিন্নি মহালয়া কি জানে । বাবা বলেছিল । মাকে ডেকে ও বলল , ' মা পুজোর আর সাতদিন বাকি । পুজোতে সবাই নতুন জামা পড়ে তাই না মা ' ? ছায়া তিন্নির কথা শুনে বলল , ' খাওয়া জোটে না যাদের , তাদের আবার নতুন জামা ' ! তিন্নিও জানে সে কথা । তবু মাঝে মাঝে ওর ছোট্ট মনটা যে মনে মনেই অনেক কিছু আবদার করে ফেলে । তিন্নি চলে গেলো নিজের কাজে ।
কয়েকদিন ধরে সুমি দিদি আসেনা । কিজানি , অসুখ করলো নাকি ? সুমি দিদির বাড়িও তো তিন্নি চেনেনা যে খোঁজ নিতে যাবে । সুমি দিদি না আসলে ওর মনটা খারাপ লাগে । মা ছাড়া ওই সুমি দিদিই তো একমাত্র মানুষ যে ওকে ভালোবাসে । বাড়ির ঠিকানা জানা থাকলে হয়তো চলেই যেত সুমি দিদির বাড়ি । কাল পঞ্চমী । শপিং মলটা কি সুন্দর করে আলো দিয়ে সাজিয়েছে । আবছা বিকেলেই সব আলো জ্বলে উঠেছে । রাস্তাতেও আলোর রোশনাই । কাছেই নবারুন সংঘে একটা বড় পুজো হয় । চারিদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ শপিং মলের ওই দোকানটার দিকে চোখ পড়ল তিন্নির । খুব বিষন্ন হয়ে গেলো ওর মুখটা । চোখটা জলে ভিজে চিকচিক করে উঠলো । ওর হরিণের মতো টানা টানা চোখে যেন আলোর প্রতিফলন হচ্ছে । তিন্নির খুব পছন্দের লং ফ্রকটা ওই পুতুলটার গায়ে আর নেই । ওই পুতুলটা আজ নতুন জামা পড়েছে । কেউ হয়তো কিনে নিয়েছে ফ্রকটা । তিন্নি আর কখনো স্বপ্ন দেখবে না । মাথা নিচু করে ও ওর বেচে যাওয়া সব্জির ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে এগোলো । হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন ডাকছে , ' তিন্নি , অ্যাই তিন্নি , দাঁড়া ' । আরে এতো সুমি দিদির গলার আওয়াজ ! ও ঘুড়ে তাকালো । আজকে সুমি দিদি একটা শাড়ী পড়েছে । তিন্নি ছুটে চলে গেলো ওর কাছে । কিন্তু সুমি দিদির সঙ্গে ওটা কে ? তিন্নিকে ইতস্ততঃ করতে দেখে প্রবাল নিজেই এগিয়ে এসে বলল , ' আমি তোমার সুমি দিদির বন্ধু । আর তোমারও নতুন বন্ধু । তুমি আমাকে চেনো না । কিন্তু আমি তোমাকে খুব ভালো চিনি । সুমি প্রায় সারাদিন আমার কাছে তোমার গল্পই করে । আজকে তাই তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চলে এলাম । আমার বন্ধু হবে ' ? তিন্নি লাজুক লাজুক হেসে মাথা নাড়ল । তারপর সুমিকে বলল , ' তুমি আসোনি কেন এতদিন ? তোমাকে না দেখলে আমার ভালো লাগে না ' । সুমি বলল , ' বাবার শরীরটা ভালো ছিলো না রে ! তাই কলেজ যেতে পারিনি , আর তোর সাথেও দেখা হয়নি ' । তিন্নি বলল , ' আমি যাই সুমি দিদি । মা চিন্তা করবে ' । সুমি তিন্নির হাতটা ধরে ওর হাতে দুটো প্যাকেট দিয়ে বলল , ' তিন্নি এটা তোর পুজোর উপহার । তোর মায়ের জন্যেও আছে ' । তিন্নি বলল , ' কি আছে গো ' ? সুমি বলল , ' দুটো জামা তোর জন্যে আর দুটো শাড়ি তোর মায়ের জন্যে ' । তিন্নি আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল , ' নতুন জামা ? কি মজা ! কি মজা ! এবার পুজোয় আমিও নতুন জামা পড়বো ' ! বলতে বলতে দুবার পা তুলে নেচে নিল তিন্নি । তারপর হঠাৎ মুখটা করুণ করে বলল , ' মা যদি বকে ? মা তো কারো কাছ থেকে এমনি এমনি কিছু নিতে বারণ করে ' । সুমি বলল , ' বকবে না । তোর মা তো জানে আমার কথা ' । তিন্নি বলল , ' হ্যাঁ তাই তো ! তুমি দিলে কিছু বলবে না ' । ওর চোখে মুখে মিলিয়ে যাওয়া আনন্দটা আবার ফিরে এলো । প্রায় নাচতে নাচতে ও বাড়ি এলো । সুমি তিন্নির আনন্দটা উপভোগ করছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে । দারুণ প্রশান্তিতে ওর মন ভরে উঠছিল । সারা পৃথিবীর দুঃখ দূর করার সাধ্য ওর নেই , কিন্তু একজনের মুখে তো ও হাসি ফোটাতে পেরেছে ! জীবনে অনেক ভাবে সুমি আনন্দ পেয়েছে । কিন্তু এই আনন্দ যেন সব কিছুকে ছাপিয়ে গেলো । সুমি প্রবালকে বলল , ' বাড়ি গিয়ে তিন্নি যখন প্যাকেট খুলবে , কত আনন্দ পাবে ও বল ' ! প্রবাল সুমির মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল ।
তিন্নি বাড়ি এসে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল , ' মা পুজোয় নতুন জামা পড়বো ! তুমিও নতুন শাড়ি পড়বে । সুমি দিদি দিয়েছে । দুটো করে দিয়েছে জানো ? তোমাকে বলেছিলাম না , সুমি দিদি খুব ভালো ' ! ছায়া মেয়ের চোখে এত আনন্দ অনেকদিন পর দেখল । ওর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো । মনে মনেই প্রান ভরে আশীর্বাদ করলো সুমিকে । তিন্নি প্যাকেট খুলে মায়ের শাড়িগুলো দিলো । নিজেরটাও দেখল । কি সুন্দর জামাটা ! দ্বিতীয় প্যাকেটটা খুলে ও অবাক হয়ে গেলো ! আরে ! এটা তো সেই শপিং মলের সাদা লং ফ্রক টা ! সাথে সাদা জুতোটাও আছে । তিন্নি খুশিতে পাগল হয়ে গেলো । ফ্রকটা পড়ে নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো , আমি আর স্বপ্ন দেখবো না মা ! এটা তো স্বপ্ন না ! একদম সত্যি ! একদম সত্যি ! ছায়া ওর কথা বুঝতে পারলো না ঠিকই , কিন্তু মেয়ের এই উচ্ছ্বাস দেখে ওর চোখের জল বাঁধ মানলো না , ভিজিয়ে দিলো ওর গালদুটো ।
সমাপ্ত
--------------------