অনির্বচনীয় ....✍স্বাগতা পাল




ভুতের গল্প

অনির্বচনীয়

স্বাগতা পাল


---আ আমি কোথায় ? তোমরা কারা ? আমি বাড়ি যাবো। এ এ একি, আমার হাতগুলো বাঁধা কেন ? আমায় ছেড়ে দাও প্লিজ, ছেড়ে দাও-- বাড়ি যেতে দাও। অঝোরে কাঁদতে থাকেন মহুল রায়, কলকাতার এক বিখ্যাত মিউজিক অ্যাকাডেমির সিনিয়র মেন্টর।
---করছেন কী মিসেস রয় ? অনেক কষ্টে আপনার প্রায় মৃত শরীরে প্রাণসঞ্চার করতে পেরেছি, সে মেহনত বিফল হতে দেবেন না প্লিজ। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে আপনার। আমি আপনার ডক্টর, নাম দীপ্ত সেন। আর আপনার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আই সি ইউ-এর চিফ সিস্টার অদিতি মুখার্জী। এই অদিতি, এখন ওনার হাতগুলো খুলে দাও। এখন তো মনে হচ্ছে ফুল কনসাস।
---হ্যাঁ স্যার, দিচ্ছি। নির্দেশমতো আজ্ঞা পালন করেন অদিতি। ডক্টর দীপ্ত মনিটরটা দেখে নিয়ে আবার কথা বলতে শুরু করেন-- "এখন কী কী প্রবলেম ফিল করছেন ম্যাডাম ? খুলে বলুন, লুকোবেন না। যে ধরণের অ্যাটাক আপনার হয়েছে, তা কিন্তু একদিনে হয় না। অথচ আপনার হাজব্যাণ্ড আর ছেলে এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। ভেরি স্ট্রেঞ্জ !"
---আমার হাজব্যাণ্ড জানলো কী করে ? আমি তো--
---জানি, আপনি আপনার মিউজিক অ্যাকাডেমিতে সরস্বতীপূজোর জন্য ঘর সাজাচ্ছিলেন। সারাটাদিন খাটাখাটনির পরে রাত প্রায় ৯টা নাগাদ আপনি অসুস্থ হন। ভয় পেয়ে ওখানকার বাকী দু'জন মেন্টর আপনার হাজব্যাণ্ডকে ফোনে খবর দেন আর দেরী না করে তক্ষুনি অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আপনাকে এখানে নিয়ে আসেন ওনারাই। অল্পবয়সী হলেও যথেষ্ট অভিজ্ঞ ওনারা। একি, চমকে উঠলেন কেন ?---মহুল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন ডক্টরের মুখের দিকে, কিন্তু কিছুই বলতে পারেন না। কীই বা বলবেন ? তাঁর চোখের সামনে এখন যে ছবিগুলো ভেসে উঠছে আর ডক্টরের মুখে যা শুনছেন, এ দুইয়ের মধ্যে যে কোনো মিল নেই ! "আমি একটু ঘুমোবো ডক্টর। পরে সব বলবো।" বুকের ওপর হাতদুটো রেখে চোখ বন্ধ করেন মহুল।--"ওকে, ওকে, ইভনিং রাউণ্ডে এসে সব কথা শুনবো। এখন একটু স্যুপ খেয়ে নিয়ে আপনি রেস্ট নিন। বাই।" মহুল বন্ধ চোখে আবার দেখতে থাকেন তাঁর সামনে আচমকাই ঘটে যাওয়া অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো। সকাল থেকে আলপনা দিয়ে, ঘর আর ঠাকুর সাজিয়ে সন্ধে ৬টা নাগাদ স্টুডেন্টরা সব যে যার বাড়ি চলে গেলো। রয়ে গেলেন মহুল, সাথে মাস ছয়েক হলো মেণ্টর হিসেবে নিযুক্ত প্রেমিক জুটি আদিত্য আর নিশা। লাইটগুলো লাগিয়ে ওনাদেরও চলে যাবার কথা। এবারকার ছেলেমেয়েগুলো বড় ভালো সাজিয়েছে ঘরটা। প্রাণভরে দেখে নিয়ে আদিত্য আর নিশাকে তাড়া দিতে গিয়েই দেখেন দু'জনেই নিজেদের মোবাইলে মগ্ন হয়ে রয়েছে। একটা দুষ্টুবুদ্ধি জাগলো মহুলের মাথায়। পা টিপে ওদের ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাত থেকে পেরেক ঠোকার হাতুড়িটা একটু উঁচু থেকে মাটিতে ফেলে দিলেন। নিঃশব্দ ঘরে হঠাৎ ওই আওয়াজে প্রেমিক জুটি এমন ঘাবড়ে গেলো যে, ওদের হাত থেকে মোবাইলগুলো মাটিতে পড়ে গেলো। খিলখিল করে হাসতে হাসতে মহুল বলে উঠলেন-- "আজকালকার ছেলেমেয়ে হয়ে এত ভীতু তোরা ? এইজন্যই এই সুন্দর ঘরে তোরা ভূত দেখিস। জানিস, আজ দশ বছর ধরে এই ঘরে আমি ক্লাস করছি। ততবছর ধরেই এ ঘরের তিন দেওয়াল জুড়ে এই বিশাল বিশাল আয়নাগুলো লাগানো। কই আমি তো কখনও আয়নায় ভূত দেখি নি ? বেশ কিছু রাতে আমি এই ঘরে একা থেকেওছি, বুঝলি ? নিজের বাড়ির চেয়েও গভীর ঘুম ঘুমিয়েছি। কী হলো ? গোল্লাগোল্লা চোখে তাকিয়ে আছিস কেন ? এবার কী আমাকে পেত্নী মনে হচ্ছে ?" মহুলের হাসির ফোয়ারাকে থামিয়ে দিলো আদিত্য আর নিশার তর্জনীর ইশারা ; দরজা আর ঠাকুরের দিকে দেখাচ্ছে ওরা। স্তম্ভিত হয়ে মহুল দেখলেন, দরজার মাথায় সাজানো রঙবেরঙের প্লাস্টিকের মালাগুলো পেরেক শুদ্ধু উপড়ে মাটিতে পড়ে। বেদী থেকে সরস্বতী প্রতিমাও উপুড় হয়ে মাটিতে। "এসব কি করে হলো আদিত্য ? কোনো শব্দও তো পেলাম না ! ঠাকুরটা তোল না রে আদিত্য, আমি একা পারবো না। কিরে, সাড়া দিচ্ছিস না কেন ?"
---কী করে সাড়া দেবে ও মহুল দি ? তাকিয়ে দেখো, তোমার প্রিয় ঘরের আয়না ওর কী অবস্থা করেছে ? --- নিশার কান্নাজড়ানো কথাগুলো শুনে চমকে উঠে ডানদিকে তাকাতেই ভয়ে শিউরে ওঠেন মহুল। দেওয়াল জোড়া আয়না আদিত্যর মাথা গিলে ফেলেছে। ধড়টা বাইরে ঝুলে কাটা ছাগলের মতো ছটফট করছে !
        
--- "হে ভগবান, কী হচ্ছে এসব ? আদিত্যর হাতদুটো টেনে ধর নিশা। আমি-- আমি দৌড়ে গিয়ে চা-এর দোকানের সকলকে ডেকে আনি। আদিত্যর কিচ্ছু হতে দেবো না নিশা। সব আয়না আজই আমি ভেঙে ফেলবো।" কাঁদতে কাঁদতে আর্তনাদ করে বলেন মহুল। আর তখনই--- "সেকি গো, ভয় পেয়ে গেলে মহুল দি ? এটা তো একটা মজার খেলা। তুমিও এসো না মহুল দি, আমাদের সাথে এই ভূতুড়ে খেলা খেলবে। খুব মজা পাবে, দেখো। হি হি হি..." নিশার এই অদ্ভূত হাসিতে ভয়ে অবশ শরীরে পিছন ফিরেই মহুল দেখলেন আয়নার ভিতর নিশা অদৃশ্য ; শুধু তার হাতদুটো আয়না থেকে বেরিয়ে ক্রমশঃ লম্বা হয়ে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। আর নিশার ওই কর্কশ হাসির সাথে আদিত্যর পৈশাচিক অট্টহাসি মিশে গিয়ে সমস্ত ঘরটাকে যেন ফাটিয়ে দেবে মনে হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে মহুলের চোখের সামনে নেমে এলো অন্ধকার। চোখ খুলতেই নিজেকে এখানে দেখতে পেলেন। অথচ ডক্টর দীপ্ত বলছেন, আদিত্য আর দীপ্তই ওনাকে এখানে নিয়ে এসেছেন ! মহুলের স্বামী আর ছেলেও ওদের দেখেছে ! তাহলে মহুল কী বলবেন ডক্টর দীপ্ত সেনকে ? নাহ, কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারছেন না মহুল। "ম্যাডাম, স্যুপটা খেয়ে নিন প্লিজ। এরপর আপনাকে একটা ইঞ্জেকশন দেবো। উঠুন। কী হলো ? আমাকে চিনতে পারছেন না ? আমি সিস্টার অদিতি, ডক্টর সেন বলে গেলেন মনে নেই ? একি ঘামছেন কেন এত ? কথা বলছেন না কেন ?"--- সত্যিই এবার কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়েছেন মহুল। তাঁর সামনে কবজি পর্যন্ত কাটা দুটো হাত স্যুপের বাটি নিয়ে শূণ্যে ঝুলছে !
--------------------
ভাষাপথ অ্যাপটি ব্যবহার করবার জন্য ধন্যবাদ। এই অ্যাপটি ভালো লাগেল, অবশ্যই ফাইব ষ্টার রেট দেবেন এবং কমেন্ট করে আপনাদের মতামত জানাবেন এবং সকলের সাথে শেয়ার করে নেবেন।