নদিয়ার রথযাত্রা....✍জয়শ্রী রায় মৈত্র
ইতিহাস
নদিয়ার রথযাত্রা
জয়শ্রী রায় মৈত্র
রথ শব্দটি বোঝাতে সর্বপ্রথমে আমাদের মনে আসে পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ছবি । প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ “ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ” ও “পদ্মপুরাণ”-এও এই রথযাত্রার উল্লেখ আছে । পদ্মপুরাণ অনুযায়ী আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রার অনুষ্ঠান শুরু হয় এবং একাদশী তিথিতে পূর্ণযাত্রা বা উল্টোরথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় । পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রাও প্রতি বছর এই নিয়মেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে । পুরাণযুগ থেকেই এই রথযাত্রার প্রচলন । “উৎকলখণ্ড” ও “দেউলতোলা” নামক ওড়িশার প্রাচীন গ্রন্থগুলি থেকে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় যে এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় সত্যযুগে । সেই সময় ওড়িশার নাম ছিল মানবদেশ । সেই মানবদেশের অবন্তীনগরী রাজ্যের সূর্যবংশীয় পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বিষ্ণুর জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা প্রচলন করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন । পরবর্তীতে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন করেন । তারপর থেকে পুরীর রথযাত্রাকে অনুসরণ করে সারা দেশে রথযাত্রার অনুষ্ঠান বিস্তার লাভ করে ।
সারা দেশের সাথে পশ্চিমবাংলার নদিয়া জেলায়ও রথযাত্রার অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে । প্রথমেই অবিভক্ত নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজধানী এবং বর্তমান নদিয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে । কৃষ্ণনগরে প্রথম রথযাত্রার সূচনা করেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র মহারাজা গিরিশচন্দ্র । প্রায় দু’শো বছরের পুরানো নদিয়ারাজের রথ দীর্ঘদিন ধরে কৃষ্ণনগরে চলছে । আনুষ্ঠানিকভাবে রাজবাড়ির কূলদেবতা অগ্রদ্বীপের গোপীনাথের জন্যই প্রসিদ্ধ । কথিত আছে চৈতন্যদেবের নির্দেশে গোবিন্দ ঘোষ নামে এক ব্যক্তি অগ্রদ্বীপে ‘গোপীনাথ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । কিন্তু ষোড়শ শতকের শেষ দিকে মূর্তিটি চুরি হয়ে যায় । প্রায় এক শতক পরে বর্ধমানের পাটুলির জমিদার মূর্তিটি উদ্ধার করেন এবং গোপীনাথের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেন । ঘটনাচক্রে গোপীনাথের মেলায় এক দুর্ঘটনা ঘটায় তদানীন্তন বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ গোপীনাথের দেখভালের জন্য নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা রঘুরামকে দায়িত্ব দেন । তারপর থেকে গোপীনাথের নিরাপত্তার ভার নদিয়ার রাজপরিবারের হাতে চলে যায় । বছরের বেশিরভাগ সময়ে গোপীনাথ রাজবাড়িতেই থাকতেন । অগ্রদ্বীপে যেতেন দুর্গাপূজার পর এবং কৃষ্ণনগরে ফিরতেন চৈত্রমাসে বারোদোল উৎসবে । পরবর্তীতে মহারাজা গিরিশচন্দ্রের প্রচলিত রথযাত্রায় গোপীনাথ শোভিত থাকতেন । কিন্তু দুঃখের বিষয় গোপীনাথকে নদিয়ার রাজপরিবার ধরে রাখতে পারেনি । তিনি স্থায়ীভাবে অগ্রদ্বীপে ফিরে গিয়েছেন । সাম্প্রতিককালে তাঁর বিগ্রহ ছাড়াই শুধুমাত্র তাঁর ছবি দিয়ে এই রথযাত্রা সম্পন্ন হয় । কৃষ্ণনগরে নতুন বাজারের গোপীনাথ মন্দিরের পাশে রথ থাকে । সেখান থেকে নতুন বাজারের মোড় পর্যন্ত মাত্র কয়েকশো ফুট এই রথের যাত্রাপথ । মহারাজ গিরীশচন্দ্রের আমলে রথটি ছিল কাঠের । পরে তা নষ্ট হয়ে গেলে স্থানীয় বাসিন্দাবৃন্দ ও নতুন বাজার ব্যাবসায়ী সমিতির সাহায্যে পুনরায়ঃ নতুন কাঠের রথ নির্মিত হয় । পরবর্তীতে সেটিও নষ্ট হয়ে যায় । শেষে ১৯৯১ সালে সাড়ে উনিশ ফুট উচ্চতাযুক্ত লোহা দ্বারা নির্মিত একটি রথ প্রস্তুত করা হয় । কথিত আছে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা তাঁর মাসির বাড়ি পর্যন্ত যায় এবং মাসির বাড়ি থেকে ফেরার দিনই অনুষ্ঠিত হয় উল্টোরথযাত্রা । রথযাত্রা এবং উল্টোরথযাত্রার দিন কৃষ্ণনগর পোষ্ট অফিসের মোড়, ঘূর্ণি, বউবাজার সহ বিভিন্ন পাড়ায় ছোট বড় অনেকগুলি সুসজ্জিত রথ জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে । কাঙ্ক্ষিত মনস্কামনা নিয়ে বহু পুন্যার্থী রথের দড়ি ধরে টানেন । এই উৎসবকে কেন্দ্র করে কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসে ।
শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মভূমি নদিয়ার মায়াপুরেও সাড়ম্বরে পালিত হয় শ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা । শত শত দেশ-বিদেশের ভক্তদের বিভিন্ন বাদ্য ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে রশির টানে এগিয়ে চলে । ভক্তদের মিলিত “জয় জগন্নাথ” ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মায়াপুরের আকাশ বাতাস । মাসির বাড়ি হিসাবে গণ্য চন্দ্রোদয় মন্দিরে সাত দিন কাটিয়ে আবার উল্টোরথযাত্রায় একই ভাবে ফিরে চলেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা । পাশেই বৈষ্ণব তীর্থ পুণ্যভূমি নবদ্বীপ । সেখানেও বিভিন্ন মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় পূজা-পার্বণ এবং রথযাত্রা । এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মায়াপুর এবং নবদ্বীপে বিভিন্ন জিনিষের পসরা সাজিয়ে মেলা বসে ।
আর এক বৈষ্ণবতীর্থ শান্তিপুরে রথের মেলায় পর্যটক দিশা হারাতে পারেন মেলা রথের ভিড়ে । শান্তিপুরের রথযাত্রা প্রধানতঃ ‘রঘুনাথ’-এর রথযাত্রা । শহরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রথগুলির প্রত্যেকটিতেই রামচন্দ্রের গুরুত্ব জগন্নাথদেবকে ছাপিয়ে গিয়েছে এখানে । শান্তিপুরের সবচেয়ে প্রাচীন বড় গোস্বামী বাড়ি, মধ্যম বা হাটখোলা গোস্বামী বাড়ি ও সাহা বাড়ির প্রাচীন রথে প্রধান বিগ্রহ হিসাবে শোভা পায় রঘুনাথ বা রামচন্দ্রের মূর্তি । সঙ্গে জগন্নাথদেব থাকলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে জগন্নাথদেব থাকেন একা । বলরাম ও সুভদ্রা এখানে অনুপস্থিত । এই প্রসঙ্গে এক বিশেষ প্রশ্নের অবতারণা হতে পারে যে বৈষ্ণবতীর্থ শান্তিপুরে রথের প্রধান দেবতা রঘুনাথ বা রামচন্দ্র হলেন কেন ? কিন্তু এই ব্যাপারে কোন স্পষ্ট ধারণা মেলে না । শ্রীচৈতন্যদেবের প্রধান সেবক ও ভক্ত সিলেট থেকে আসা বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের অদ্বৈতাচার্যের বংশধর বিভিন্ন গোস্বামী বাড়িতে অধিষ্ঠিত রয়েছে দুর্লভ সব কৃষ্ণবিগ্রহ । শান্তিপুরের সুবিখ্যাত ভাঙ্গারাসে শোভিত এই সব বিগ্রহগুলি রথযাত্রার অনুষ্ঠানে প্রাধান্য পেলেও কিছু বলার ছিল না । কিন্তু তার বদলে রঘুনাথ তথা রামচন্দ্রের বিগ্রহ রথের শোভাযাত্রায় কেন স্থান পায়, এই কৌতূহলের জবাবে স্থানীয় ইতিহাসও নীরব । তবে এ-ব্যাপারে শান্তিপুরের খোঁজখবর রাখা এক কবির কথা “কোন পাথুরে প্রমাণ না থাকলেও এমনটা হতে পারে যে, ফুলিয়ার কৃত্তিবাসকে স্বীকৃতি দিতেই রামের গুরুত্ব বেড়েছে” কৌতূহলের জবাব আংশিকভাবে মিটিয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায় । কারণ তাঁর যুক্তি ফেলে দেওয়ার মতো নয় । শান্তিপুরের অদূরে ফুলিয়ায় কৃত্তিবাস বাংলা রামায়ণ রচনা করেছিলেন।
নদিয়া জেলার দক্ষিণে পানরানাঘাট যা বর্তমানে রানাঘাট নামে পরিচিত । নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে এখানকার জমিদারীর দায়িত্বে ছিলেন পালচৌধুরী জমিদাররা । সেই সময় অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর মহকুমাও অবিভক্ত নদিয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং পালচৌধুরীদের জমিদারী অঞ্চলের মধ্যে ছিল । এই পালচৌধুরীদের হাত ধরেই এককালে রানাঘাটের সমৃদ্ধি ঘটেছিল । রথযাত্রাও তার ব্যাতিক্রম নয় । কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির রথযাত্রা অনুষ্ঠান সূচিত হওয়ার পরপরই রানাঘাটে রথযাত্রার অনুষ্ঠান উদযাপনের সূচনা হয় । পালচৌধুরীদের রথযাত্রা ছিল জৌলুসে ভরা জমজমাট। এই রথযাত্রা উপলক্ষে প্রচুর প্রজা-ভক্তদের সমাগম হত । পরবর্তীকালে শরিকি বিবাদের কারণে জমিদার ভাতৃদ্বয় কৃষ্ণপান্তি ও শম্ভুপান্তি তাঁদের সম্পত্তি আলাদা করে নেন । তারপর থেকে তাঁদের রথযাত্রার অনুষ্ঠানও পৃথক ভাবে অনুষ্ঠিত হত । কালের অমোঘ নিয়মে সেই ঐতিহ্যপূর্ণ এবং জৌলুসপূর্ণ রথযাত্রা তার জৌলুস হারিয়ে আজ বিবর্ণ । রথের রশিতে টান দিতে আজ আর ভক্তরা আসেন না । তাই জগন্নাথদেবও পাড়ি দেন না মাসির বাড়ি । বাড়ির উঠোনেই অবস্থান করেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। তবে শহরের বিভিন্ন মহল্লায় বিভিন্ন ছোট রথযাত্রার অনুষ্ঠান হয় ।
নদিয়া জেলার কয়েকটি ঐতিহ্যপূর্ণ রথযাত্রা ছাড়াও জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছোট বড় অনেক রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে । নদিয়া জেলার আড়ংঘাটায় যুগলকিশোর মন্দির সুপ্রাচীন এবং বিখ্যাত । মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরটিতে রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ আছে । প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে মন্দির প্রাঙ্গনে একমাসব্যাপী মেলা বসে । এই মেলা যুগলকিশোরের মেলা নামে প্রসিদ্ধ । এখানেও রথযাত্রা হয় । রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে যেমন মন্দিরটি প্রায় ধ্বংসের মুখে ঠিক তেমন ভাবেই রথযাত্রাও ম্রিয়মাণ । মন্দিরের বর্তমান সেবাইত এবং স্থানীয়রা মন্দির প্রাঙ্গনেই অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ করেন । করিমপুর থেকে শুরু করে কল্যাণী পর্যন্ত নদিয়া জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের রথের শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় এবং রথের রশিতে টান দিতে অংশগ্রহণ করেন ।