রামায়নের পথে পথে ......✍প্রাণ কৃষ্ণ মিশ্র





ভ্রমণ

রামায়নের পথে পথে

প্রাণ কৃষ্ণ মিশ্র


মঞ্জু ত্যাগী  দিল্লীতে থাকেন। আমার খুব আপনজন। গত অক্টোবর,২০১৭ এর কোন এক দিন হঠাৎই উনি ফোন করেন আমায় চিত্রকূট ধামে যাওয়ার জন্য। চিত্রকূট সম্বন্ধে সাধারন কিছু ধারনা পূর্বেই আমার ছিল। ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। অত্রি মুনি ও সতি অনুসূয়া মায়ের তপস্যা স্থল চিত্রকূট। শ্রী রামচন্দ্র তাঁর বনবাস কালে চিত্রকূটেই ১১ বৎসর কাটিয়েছিলেন। বনবাস সময়কালে অযোধ্যার রাজা ভরত, রামচন্দ্রকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এখানেই এসেছিলেন বর্নিত আছে রামায়ণে। তপস্যি তুলসীদাস এখানেই রামচরিতমানস লিখেছিলেন। আরো আরো অনেক গল্পগাঁথা রচিত হয়েছে চিত্রকূটকে ঘিরে। হাওড়া স্টেশন থেকে চম্বল এক্সপ্রেস ধরি ৫ই ফেব্রুয়ারি,২০১৮  আমি ও বাবুলাল।বিকাল ৫.৪৫ এ চম্বল এক্সপ্রেস হাওড়া ছাড়ে। একটির পর একটি গ্রাম ছাড়িয়ে,মাঠ ছাড়িয়ে, শহর, নগর  নদী পেড়িয়ে চম্বল এক্সপ্রেস ছুটে চলে চিত্রকূটধামের পথে। সকাল ১০.০০ টায় পৌঁছানোর নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়ে ট্রেন ১২ টায় পৌঁছায় চিত্রকূট স্টেশনে। এদিকে বারেবারে মঞ্জু দি ফোনে খোঁজ নিচ্ছেন গাড়ি কত দূরে।
পরের দিন দুপুর ১২ টায় চিত্রকূট স্টেশনে নেমে অটো ভাড়া করে আমরা মহন্ত রামদাসজীর আখড়ায় পৌঁছাই।  এই আশ্রমেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা।
চিত্রকূট জনপদটি অধুনা দুটি রাজ্যে অন্ত:র্গত। মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশে। আমরা আশ্রমে পৌঁছে স্নান ও প্রসাদ(লাঞ্চ) করে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পরি ঘুড়তে। আসলে নতুন কে জানার ইচ্ছা। এই দিনটি পুরোটাই বিশ্রাম নিলেই ভাল হতো। কিন্তু হাতে আমাদের মাত্র ৩ দিন। যাবার সময়ই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম চিত্রকূট থেকে ১৬৬ কিমি আগেই বিন্ধ্যাচল ঘুরে নেব। যেখানে পুরান বর্নিত শুম্ভ,নিশুম্ভ ও রক্তবিজ দানবদের হত্যা করেছিলেন দেবী দূর্গা।



চিত্রকূটের দর্শনীয় স্থান গুলিকে আমরা দুটি ভাগে ভাগ করেছিলাম। তাই প্রথম দিন আমরা একটি অটোরিক্সা ভাড়া করে প্রথমে যাই রামশোয়ে। বনবাসকালে একটি প্রকান্ড পাথরের উপর যেখানে সীতা ও রামচন্দ্র  শয়ন করতেন। আজো রামশোয়ে তে সেই চিহ্ন বর্তমান। "রামশোয়ে" দর্শন করে পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করতে করতে আমাদের গাড়ি পৌছায় "ভরতকূপে"। এক প্রকান্ড ইদারা। এখানেই ভরত তাঁর মায়ের অপরাধের প্রায়:শ্চিত্ত করার জন্য বিভিন্ন তীর্থ থেকে জল নিয়ে এসে সঞ্চয় করেছিলেন। স্থানীয় মানুষের বক্তব্য এই কূপের জল ভক্তির  সাথে পান করলে জটিল রোগ থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়।ভরতকূপ দর্শন করার পর আমরা ফিরে আসি কামোদগিড়ি বা কামোদনাথ পাহাড়ে। খালিপায়ে আমরা "কামোদগিড়ি" পাহাড় পরিক্রমা করি। এই পরিক্রমায় আমাদের সময় লাগে ১.৩০ ঘন্টা। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কামোদগিড়িতে বিভিন্ন মন্দিরে আরতি শুরু হচ্ছে। কাঁসর,ঘন্টা, বাদ্য সহযোগে আরতির আওয়াজে আকাশ বাতাস মুখরিত। পরিক্রমা করতে করতেই দেখে নিই ভরতমিলাপ স্থল।এখানেই রাজা ভরত রামচন্দ্রকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে  নিয়ে যাবার জন্য মিলিত হয়েছিলেন। সীতা মা, রামচন্দ্র, কৈকেয়ি সহ অনেকের ছড়িয়ে ছিটিয়ে পদচিহ্ন পাওয়া যায় এখানে। মন মুগ্ধ করা পরিবেশ কামোদগিড়িতে। তবে লঙ্গর ও বাঁদরের উৎপাত ও সংখ্যাধিক্য ভীষন। সন্ধ্যায় কামোদগিড়ি থেকে ফিরে আমরা মন্দাকিনী নদীর ধারে আসি সন্ধ্যা আরতি দেখতে। সাজোসাজো রব চারিদিকে। প্রচুর মানুষের সমাগম। মন্দাকিনীর রামঘাট অপূর্ব ও মনোমুগ্ধকর। যা আপনাকেও মুগ্ধ করবে শহুরে কোলাহল থেকে বাঁচতে।
ট্রেন যাত্রার ক্লান্তিতে শরীর নিস্তেজ। এদিকে ঠান্ডার প্রকোপ বাড়ছে রাত বাড়ার সাথে সাথে। তাই বিশ্রাম নেবার জন্য ফিরে যাই আশ্রমে। রাত্রে আশ্রমে নিশি আরতি দেখে প্রসাদ খেয়ে ঘুমের রাজ্যে পৌঁছাই কামোদগিড়ির চিন্তায় মুগ্ধ হয়ে।
৬ ই ফেব্রুয়ারী সকাল সকাল উঠে স্নান করেই বেড়িয়ে পরি গুপ্ত গোদাবরী দর্শনে। যা এই ভ্রমনের মুখ্য দ্রষ্টব্য স্থল। সকালে শরীর একটু খারাপ। তাই প্রাতরাশ পথেই করার সিদ্ধান্ত। আমাদের গাড়ি ছুঁটে চলে।  সুউচ্চ পাহাড়ের উপর যে এত প্রকান্ড এক গুহা থাকতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এখানে গোদাবরীর উৎস ও বিলীন হয়ে যাওয়া দুটিই গুপ্ত। অনেকগুলি ধারায় গোদাবরী কোথাও সংকীর্ন আবার কোথাও বা গভীর ধারায় বয়ে চলেছে পাথর ভেঙে।এক দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ।কথিত শ্রী রামচন্দ্রকে দর্শন করতেই গোদাবরীর চিত্রকূটে আগমন।


গুপ্তগোদাবরী দর্শন করে আমাদের গাড়ি ছুটল সতী অনুসূয়া  দর্শনে। মন্দাকিনীর তীরে পাহাড়ের উপর গভীর অরন্যের মধ্যে অত্রী মুনির আশ্রম অপূর্ব। বর্তমানে সুন্দর মন্দির তৈরী হয়েছে এখানে।এখানে মন্দাকিনীতে বড় বড় মাছ, কচ্ছপ দেখলাম।কেউ তাঁদের ধরে না। এখানে মাছ ধরা ঘৃন্য,  অপরাধ । আমি ভাবলাম ভাগ্যিস বাঙালী নেই এখানে। থাকলে এই বড় বড় মাছও লুপ্ত হত এই অরন্যের নদীতে।
এরপর সীতাকুন্ড দর্শন। স্ফটিক শীলা দর্শন। এক বৃহৎ আকারের স্ফটিক শিলায় শ্রীরামচন্দ্র ও সীতা মায়ের পদচিহ্ন। আর এই পদচিহ্ন দেখিয়ে বর্তমান যুগে রামভক্ত পাণ্ডাদের চিত্রকূটে উৎপাত। আপনার মন না চাইলেও পকেট খালি হতে বাধ্য করবেই এখানে।
রামায়ন বর্নিত কাহিনী অনুসারে একদিন শ্রী রামচন্দ্র স্ফটিক শিলায় সদ্য স্নান সেরে উঠে আসা মা সীতাকে বনের পুষ্প দিয়ে তৈরী মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন। এই সময় ইন্দ্র পুত্র সীতার রূপে মুগ্ধ হয়ে সীতার হাত স্পর্শ করেন। শ্রী রামচন্দ্র এতে ক্রুদ্ধ হলে ইন্দ্রপুত্রের দুটি চোখ অন্ধ হয়।
পরে শ্রীরাম ইন্দ্রপুত্রের পরিচয় জেনে ক্ষমা করেন এবং একটি চোখ ফিরিয়ে দেন। সেই থেকে স্ফটিক শিলার কাহিনী ইতিহাস ক্ষ্যাত।
স্ফটিক শিলা দর্শন করে জানকি কুন্ডে আসা। জানকি কুন্ডেই মা জানকি স্নান করতেন। এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন নাম না জানা পাহাড়ি ফুল ও বৃক্ষরাজি।
জানকি কুন্ড দর্শন করে ফিরে আসি আমাদের আশ্রমে। এ দিকে ক্ষিদে ও পেয়েছে ভীষন। আশ্রমে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিই।
বাকি রয়ে গেছে আরো দুটি প্রধান জায়গা চিত্রকূটের। হনুমান ধারা ও সীতা রসুই। তাই বিশ্রাম বেশিক্ষন  না করে বেড়িয়ে পরি হনুমান ধারার উদ্দ্যেশ্যে। একটি বোলেরো গাড়ি অল্প ভাড়ায় আমাদের নামিয়ে দিতে রাজি হয় হনুমান ধারার উপরে। এই এলাকাটি পাহাড়ের অনেকটাই উপরে। হেঁটে সিড়ি বেয়ে ওঠা ও নামা সময় সাপেক্ষ ও কষ্টের। প্রায় ৭০০ অধিক সিঁড়ি। আবার রাস্তা দিয়ে গেলেও গভীর অরন্য পার হতে হয়। তাই গাড়ি ভাড়া করাই শ্রেয়।
রাবন বধ করে ফেরার সময় প্রভু হনুমান সহ বানর সেনাও অযোধ্যায় আসেন রামচন্দ্রের সাথে। চিত্রকূট রামচন্দ্রের প্রিয় জায়গা। তা ছাড়া মা অনূসুয়া ও অত্রি মুনির সাথে সাক্ষাৎলাভ রামচন্দ্রের অত্যন্ত জরুরী। তাই রামচন্দ্র আবার চিত্রকূটে ফিরে আসেন। রাস্তায় লক্ষ্য করেন হনুমান বারবার গা চুলকাচ্ছেন। রামচন্দ্র হনুমানকে জানতে চান কি তার অসুবিধা। তখন হনুমান বলেন "প্রভু আমার লেজে রাক্ষস সেনারা আগুন লাগানোর পর থেকেই, সেই আগুন নিভে যাওয়ার পরও সারা অঙ্গে জ্বালা ধরেছে,কষ্ট ও হচ্ছে।



এই কথা শুনে রামচন্দ্র হনুমানের গা জ্বালা শিতল ও মুক্ত করার জন্য তাঁর বান এখানে নিক্ষেপ করেন। সেই বানের আঘাতে পাথর ফেটে জল নির্গত হতে থাকে। তৎক্ষনাৎ সেই জলে হনুমান স্নান করে রোগমুক্ত হন। হনুমান ধারার জল আজো মানুষ ব্যবহার করলে রোগমুক্তি ঘটে এই বিশ্বাস। হনুমান ধারা দেখে আঁকাবাঁকা ৭০০ অধিক সিঁড়ি ভাঙতে হবে এবার। দেখে একটু ভয় পেলাম কিন্তু ভয় জয়ের ইচ্ছাও প্রবল। ধীরে ধীরে নামার রাস্তায় সীতা রসুই দর্শন করে ফেরা। পথে এক গভীর ইদারা। রোমাঞ্চ নিয়ে সকলের বাধা না মেনে ইদারার সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নামতেই মাথা ঘুরে গেল। উঠে এলাম উপরে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সাথে বৃষ্টি পড়ায় শীতের প্রকোপ ও একটু বাড়ছে। তাই ফিরে আসা আশ্রমে।
কিন্তু বিকালে কি করি? মন মেটে নি এখনো। আরো কিছু দেখার জানার বাকি। লক্ষনপাহাড়ী ট্রেক বাকি। এছাড়া কামোদগিড়ি আরো একবার পরিক্রমা করার ইচ্ছা হচ্ছে মনে।
ছুটে চললাম কামোদগিড়ির পথে, সাথে লক্ষনপাহাড়ি ট্রেক"।
রাতের কামোদগিড়ি পরিক্রমায় আমরা অনেকেই। কিন্তু লক্ষনপাহাড়ি উঠে দেখি কেউ নেই, কেবলই আমি আর বাবুলাল। একটু গা ছমছম করছে। তবুও খুব মজা হল লক্ষনপাহাড়ি ও কামোদগিড়ি।
পরের দিন মন খুব খারাপ।  সকাল সকাল উঠে স্নান করে চিত্রকূট থেকে বিদায় নেবার পালা। সাথে দু:খ দিদিকেও ছেড়ে আসতে হবে। আমাদের এই ভ্রমনে বাকি আছে বিন্ধ্যাচল। বিন্ধ্যাচল যাওয়ার ট্রেন আবার চিত্রকূট থেকে পাওয়া মুশকিল। তাই আমরা পরবর্তী স্টেশনের মানিকপুর এলাম বাস ধরে।
মানিকপুর জংশন হলে কি হবে, এখানে ট্রেন খুবই কম। আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসী অবশ্য রেল পরিষেবায় অনেকটাই এগিয়ে। প্রচুর লোকাল ট্রেন। মানিকপুর স্টেশনে ৯ টা থেকে অপেক্ষা করতে করতে দুপুর ২.০৫ এ একটি এক্সপ্রেস ট্রেন পেলাম। বিন্ধ্যাচল আসতে প্রায় ৪.২০ ঘন্টা সময় নিল। রাত্রেই বিন্ধ্যাচল পৌছে বিন্ধ্যবাসিনী মায়ের মন্দিরের সামনেই একটি বড় হোটেলে সস্তায়,মাত্র ৪০০ টাকা ভাড়ায় একটি হোটেল পেলাম। লাগেজ রেখেই রাত্রে সন্ধ্যা আরতির টানে ১ মিনিট হেঁটে পৌছালাম মায়ের মন্দিরে। আরতি দেখে মন মুগ্ধ হলো। রাত্রে আর কোথাও যাবার ইচ্ছা নেই। হালকা খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।



৮ ই ফেব্রুয়ারী সকালে ঘুম থেকে উঠেই একটি অটো ভাড়া করে চলে গেলাম বিন্ধ্য পর্বতের উপর মা অষ্টোভূজা মন্দিরে।অপূর্ব সুন্দর মন্দির। গুহা গহ্বরে মা অষ্টভূজা বিরাজমান। পাহাড়ের উপর আরো উপরে সীতাকুন্ড।
অষ্টভূজা মন্দির দর্শন করে এলাম কালিখাঁ মন্দিরে। এখানে মায়ের মুখ হাঁ করা গহ্বর। ব্রিটীশ আমলে মায়ের মুখগহ্বর দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল যে এই গহ্বরের বিস্তৃতি কতদূর? কিন্তু সমাধান হয়নি। এখানে মা রক্তবীজ অসূরকে নিধন করে রক্তপান করেছিলেন। তাই মায়ের এই অদ্ভুত রূপ। এখানে মায়ের মুখে ভ্রমনার্থীরা দুধ, জল দেন। যাতে মা শান্ত হন। পুরানে কথিত আছে "বিন্ধধাম দর্শন ত্রিলোক দর্শন সম"। জানিনা ত্রিলোক দর্শন হলো কিনা? কিন্তু মন ভালো হলো। ফিরে এসে স্নান করে বিন্ধ্যবাসিনী মাকে পূজা দেওয়া ও কেনাকাটি করা। সন্ধ্যা ৬ টায় হাওড়া ডাউন চম্বল এক্সপ্রেস।
মন খারাপ হয়ে এল। আবার সেই গতানুগতিক জীবন যাত্রা শুরু।তা হলেও চিত্রকূটধাম ও বিন্ধ্যাচল ধাম ভ্রমন মনের মণিকোঠায় স্থান পেয়ে রয়ে যাবেই বাকি জীবনে।
কিভাবে যাবেন:- হাওড়া থেকে চম্বল এক্সপ্রেস বা শিপ্রা এক্সপ্রেস ধরে বিন্ধ্যাচল বা চিত্রকূটে নামুন।
ভাষাপথ অ্যাপটি ব্যবহার করবার জন্য ধন্যবাদ। এই অ্যাপটি ভালো লাগেল, অবশ্যই ফাইব ষ্টার রেট দেবেন এবং কমেন্ট করে আপনাদের মতামত জানাবেন এবং সকলের সাথে শেয়ার করে নেবেন।