মুক্তি....✍মৌসুমী রায় ঘোষ





ভুতের গল্প

মুক্তি

✍মৌসুমী রায় ঘোষ

'চা বলুন', 'চা বলুন'
বিচিত্র সুরে একটানা চিৎকারে ঘুমটা ভেঙে গেলো। আড়মোড়া ভেঙে মাথাটা উঠিয়ে গলা বাড়িয়ে দিলাম জানলার দিকে। 'গুমটি ষ্টেশন'- আর বেশী দেরি নেই বড়োজোড় ঘন্টা দেড়েক। গলাটা আবার ফিরিয়ে এনে মাথাটা বালিশে পুনরায় স্থাপন করলাম। কতোদিন পর, প্রায় দু পুরুষ তো হবেই। সেই পুরোনো গ্রাম। 'সেন বাড়ির' বংশধর ভিটে মাটিতে পা রাখতে চলেছে। কে বা কারা যে সেখানে বর্তমানে বসবাস করে তাও তো সঠিক জানিনা। নেহাৎ মা প্রচন্ডভাবে জোড় করলো তাই। নাহলে কেউ কি এভাবে আসতে চায়। আমি তো নিরুপায় হয়ে রওনা দিয়েছি। মা আবার দু পুরুষ আগের নায়েবের নামে আমার আসার সংবাদ জানিয়ে একটা চিঠিও পোষ্ট করে দিয়েছে। কি যে বিপদ। অগত্যা আমাকে আসতেই হলো। সেখানে কে আছে কে নেই, পৌঁছে কি দেখবো তা ভগবানই জানেন। যাই হোক এই সকালে আরও খানিক ঘুমিয়ে নেওয়া যাক।

জামাকাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে ট্রেন থেকে নামলাম। খুব ক্লান্ত লাগছিলো যেন। যতোটা না ট্রেন জার্নিতে, তার চেয়েও বেশী অজানা, অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ার জন্য। মনের ওপর বেশ চাপ অনুভব করছি। অন্য কেউ হলে হয়তো এটাকে একটা এডভেঞ্চার হিসেবে নিতো। কিন্তু আমি সেসব দলে পড়ি না। নিছক অলস প্রকৃতির বাঙালী সন্তান আমি। যাই হোক এখন আর এসব ভেবে লাভ নেই। বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভাবাই ভালো। চারদিক তাকিয়ে দেখলাম, একটা মাঠের মাঝখানে ট্রেন আমাকে নামিয়ে গেলো। দেখে বোঝা যায় না ষ্টেশন বলে। আরও খেয়াল করলাম আমি ছাড়া আর কেউই তো নামেনি এখানে। ট্রেনটা আওয়াজ তুলে বেড়িয়ে যেতেই চারধারটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এবার কি করবো ভেবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে একটা লোক সামনে এসে দাঁড়ালো। শুনশান মাঠের মাঝখানে আচমকা একজনকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলাম। একটা আর্তনাদও করে ফেলেছিলাম বোধহয়। লোকটা হেসে বললো,
-'ভয় পাবেন না বাবু। আমি আপনাকে লিতে এসেচি।'
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
-'ম্-মাআনে, সেন বাড়ি থেকে?'
-'আঞ্জে হুজুর।'
আমি কিছুটা ধাতস্থ হলাম।
-'মা-র চিঠি পেয়েছিলে তাহলে?'
-'হা বাবু, ছোটোমায়ের চিঠি পেয়েই তো লায়েবমশাই মোকে পাঠালেন।' বলেই একটা দেঁতো হাসি।
নায়েবমশাই পাঠালেন, মানে ঠিক জায়গায় চিঠিটা পৌঁচেছে তাহলে। যাক তাহলে নতুন জায়গায় এসে বিপদে পরতে হবে না। অনেক নিশ্চিন্ত হলাম মনে মনে।
-'এঞ্জে বাবু চলা যাক তাহলে?'
ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে এলাম।
-'হ্যাঁ, হ্যাঁ....চলো...চলো।'
লোকটা আমার ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিলো।
ওর পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুদুর আসতেই একটা পায়ে চলা পথ, আর সেখানেই একটা পুরনো আমলের ফিটনগাড়ি জাতীয় কিছু দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সেই আগেকার জমিদারী যুগে যেমন ব্যবহার হতো সেরকমই কিন্তু জৌলুষহীন। সামনে একটা খয়াটে, রুগ্ন চেহারার ঘোড়া দাঁড়িয়ে যেন ঝিমোচ্ছে। মনে মনে মিলিয়ে নিলাম মায়ের কথার সাথে। সেই জমিদারীর কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। ভাবলাম তবু কিছু টিকে যাওয়া জিনিসপত্র হবে হয়তো।
পিছন থেকে লোকটা তাড়া দিলো,
-'বাবু, উঠে পড়ুন।'
দেখলাম ওঠার জায়গার দরজাটা ভাঙা, কিন্তু পা-দানীর সিঁড়িটা রয়ে গেছে। সঙ্গে আর কোনো লোক না দেখে বুঝলাম এই লোকটাই গাড়ির চালক। আর সময় নষ্ট না করে সাবধানে উঠে বসলাম গাড়িতে। যে 'ক্যাঁচ-কোঁচ' শব্দে গাড়ি আর্তনাদ করে উঠলো তাতে বেশ চমকে যেতে হলো। মনে মনে ভাবলাম কতোদুর যেতে হবে কে জানে। শেষ পর্যন্ত গাড়ি আস্ত থাকলে হয়।
তাকিয়ে দেখলাম লোকটা কখন গাড়িতে উঠে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। অবাক হলাম এই ভেবে যে, এইটুকু সময়ের মধ্যে কখন গাড়ি ছেড়ে দিলো আর আমি কিছু বুঝতেও পারলাম না! হয়তো গাড়ির নড়বড়ে অবস্থা দেখে যখন অবাক হচ্ছিলাম তখনই হয়তো লোকটা উঠে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছে। তবু মনের মধ্যে একটা খটকা লেগেই রইলো।

* * * * *

চারধারে সবুজ গাছ-গাছালীর মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা পথ। সেই পথে ফিটনটা ঢিমে চালে হাল্কা ছন্দে চলছে যেন। পাখিদের কলকাকলীতে ভরে আছে পৃথিবী। পরিবেশটা খুব ভালো লাগছিলো। মাঝে দুজন মানুষকেও উল্টোদিক থেকে আসতে দেখলাম। কিন্তু তাদের হাবভাবে মনে হচ্ছিলো না যে ওরা এই ফিটনটাকে দেখেছে। কেমন যেন নিজের মনেই হেঁটে গেলো তারা। একজন তো ফিটনটার অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিলো। গাড়িটা যেন প্রায় তার গায়ের ওপর দিয়েই গেলো। কিন্তু তার কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। সে আপন মনে যেমন যাচ্ছিলো তেমনি চলেছে। ফিটনচালকেরও ছিলো না কোনো উদ্বেগ। গাড়িটাকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। সব খুবই সাবলীলভাবে হচ্ছে। আমার মনে পড়লো গাড়িতে ওঠার পর থেকে আমাকে নিচে আসা লোকটা কোনো কথা বলেনি। একমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে চালকের আসনে বসে। আমার দিকে পিছন ফিরে। এতো নীরবতা কেমন যেন অস্বস্তিকর লাগছিলো। আমিই আবার কথা শুরু করলাম,
-'আচ্ছা, তোমার নামটা তো এখনো জানা হলো না। কি নাম তোমার?'
খানিক বিরতির পর উত্তর এলো,
-'এঞ্জে, ....করালি....বাবু।'
-'আচ্ছা, তো করালি তুমি কতোদিন ধরে এখানে মানে 'সেন বাড়ি'তে আছো?
-'এঞ্জে, সে বহু বছর। আমার বাপ দাদারাও এখেনে বাবুদের সেবা করেছে। তা পেরায় তিন পুরুষ তো হবেই।'
-'বাব্বা, সে তো অনেক বছর।'
-'এঞ্জে বাবু।'
আবার সব চুপচাপ। করালি মনে হয় কম কথার মানুষ। কতো আর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বলানো যায়।

কতদ্দুর আর যেতে হবে কে জানে। শেষেরদিকে বেশ একঘেঁয়ে লাগতে শুরু করেছে। গাছ-গাছালির মধ্যে আর নতুনত্ব কিছু পাচ্ছিলাম না। মনের মধ্যের অস্বস্তিটা কিছুতেই কাটছে না। যদিও এই অস্বস্তির কারনটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছিলো না। শুধু মনে হচ্ছিলো মা আমাকে কেন এখানে পাঠালো? হতে পারে আমি এ বাড়িরই একমাত্র বংশধর কিন্তু আমি কখনও এখানে আসিনি এদের কাউকে ভালো করে চিনি না। শুধু মায়ের কাছে শোনা কিছু গল্পের ওপর ভিত্তি করে আমার এই বাড়ির সাথে পরিচিতি। সেই কবে কোন কালে আমার ঠাকুর্দা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। শুনেছি তাঁর বাবা ভবানী সেনের অমতে নীচু জাতের মেয়েকে বিয়ে করায় আমার ঠাকুর্দা তারিনী সেনকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ভবানী সেন ছিলেন ভীষন গোঁড়া এবং অহংকারী মানুষ। অপরদিকে ছেলে তারিনী ছিলেন জনহিতৈষী। তিনি বিপদে-আপদে বন্ধুর মতো সাধারন মানুষের পাশে থাকতেন। সেই মানুষ এক পিতৃ-মাতৃহীন, অনাথ, অসহায়া মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলে স্বাভাবিকভাবেই ভবানী সেন মেনে নেন না। একমাত্র সন্তানকে 'এ বিয়ে হলে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হবে' এ কথা জানিয়ে দিতেও কুন্ঠাবোধ করেন না। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন বিতাড়িত হবার ভয়ে ছেলে মত বদল করবে। কিন্তু নির্লোভ তারিনী সেন পিতার আদেশ শিরোধার্য্য করলেও অসহায়ার হাত ছাড়লেন না। সেই যে তিনি বেড়িয়ে গিয়েছিলেন তারপর থেকে তার সন্তান-সন্ততী কেউই আর এমুখো হয়নি। মায়ের কাছে শুনেছি শেষ বয়সে ভবানী সেন একদম একা হয়ে গেছিলেন। দেখাশুনোর জন্য কয়েকজন চাকর-বাকর ছাড়া মৃত্যু শয্যায় তাঁর নিজের কেউ ছিলো না মুখে জল দেবার মতো। শেষ জীবনে তিনি না কি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। ছেলের অনেক খোঁজ-খবরও করেন।

হঠাৎ গাড়িটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আমার চিন্তার জাল ছিঁড়ে যেতেই তাকিয়ে দেখি এক বিশাল বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ফিটনটা। করালি কখন নেমে ফিটনটার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি তাকাতেই বললো,
-'বাবু আমরা এসে গেছি।'
আমি সাবধানে নামলাম। করালি আমাকে সাহায্য করলো।
-'আসুন বাবু।'

করালির পিছন পিছন এগিয়ে চললাম। বড় বাড়িটার প্রবেশপথ একটা সিংহ দুয়ার। সেটার সামনে এক বৃদ্ধ। বোঝাই যাচ্ছে আমাদের অপেক্ষাই তিনি করছেন। করালির সাথে আমাকে দেখতে পেয়ে,
- 'আসুন, আসতে আঞ্জা হোক' বলে তিনি দু হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন। আমাদের কাছে এসে হাতের ঈশারায় করালিকে চলে যেতে বললেন। করালি নির্দেশ পালন করলে তিনি এগিয়ে এলেন,
-'নমস্কার ছোটকর্তা আমি এ বাড়ির নায়েব।'
আমি প্রতি নমস্কার জানিয়ে জিঞ্জেস করলাম, -'মায়ের চিঠিটা পেয়েছিলেন তবে?'
নায়েবমশাই খানিকটা যেন থতমত খেয়ে গেলেন। তারপর কি যেন মনে পরতেই সহাস্যে খানিক বেস্ত সমস্ত হয়েই বলে উঠলেন,
-'হ্যাঁ, হ্যাঁ....পেয়েছি অবশ্যই, নাহলে কি করে জানবো আপনার আগমন বার্তা।'

ওনার সাথে এবার এগোতে শুরু করলাম। সিং-দরজা পেরোতেই জমিদারবাড়িটা নজরে এলো। সব চাকর-বাকর লাইন দিয়ে বারান্দায় ওঠার সিঁড়িতে দন্ডায়মান আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে। আমি যতো এগিয়ে যেতে লাগলাম তারা আমাকে মাথা নীচু করে নমস্কার জানাতে লাগলো। আমিও হাত তুলে তাদের শুভেচ্ছা কুড়োতে কুড়োতে এগোচ্ছিলাম। নিজেকে একটা বেশ কেউকেটা রাজা-গজা ধরনের মনে হচ্ছিলো। বারান্দায় উঠে ভিতরে ঢুকলাম নায়েববাবুর সাথে। উনি আমাকে কিছুক্ষন পরে একটা বিশাল, বিলাস বহুল ঘরে এনে ফেললেন। আমাকে বললেন,
-'সারারাত্রির ট্রেন জার্নিতে আপনি ক্লান্ত স্নান-খাওয়া করে বিশ্রাম নিন। সন্ধ্যেবেলা আমি এসে আপনাকে কর্তাবাবুর কাছে নিয়ে যাবো।'
আমি আর কিছু বলার আগেই উনি পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করেছেন। অগত্যা খানিক কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পর পর এতো কিছু ঘটনা ঘটে যাওয়ায় কেমন একটা হতভম্ব লাগছে। সকাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে এক এক করে সাজাতে লাগলাম। অসংগতি তেমন কিছু না পেলেও মনের মধ্যে কেমন একটা যেন অস্বস্তি কাজ করছিলো। এই এতোদুরে জঙ্গলের মাঝে আমার পুর্বপুরুষের ভিটে। যে আমি কখনও এ ভিটে মাড়াইনি সেই আমাকে এতো আদর আপ্যায়ন। কই এরা এতোদিন কোথায় ছিলো? যদিও শুনেছি ভবানী সেন অনেক খুঁজেও তাঁর ছেলের সন্ধান পান নি তবুও সব কিছুতে একটা খটকা লেগে রইলো। মায়ের কাছে তো শুনেছিলাম ভবানী সেনের শেষ সময় মুখে জল দেওয়ার কেউ ছিলো না। তাহলে এখন যারা এবাড়ির বাসিন্দা তারা কারা? ওই যে নায়েবমশাই বললেন কোনো এক কর্তাবাবুর কথা, তিনি কে? আমাকে এরা বারবার ছোটোবাবুই বা বলছে কেন? এতো আদর-যত্নই বা কিসের? এরকমই হাজারো প্রশ্ন মনের মধ্যে আসছিলো যার কোনো সদুত্তর আমার জানাছিলো না। হঠাৎ একটা খসখস আওয়াজে চমকে তাকাতে দরজায় পর্দার ওপারে কারুর উপস্থিতি বুঝতে পারি। এক কন্ঠস্বর শোনা গেলো,
-'ভিতরি আসবো ছোটোবাবু?'
সন্ধ্যেবেলায় কর্তাবাবুর সাথে দেখা হওয়ার ভাবনা তখনকার মতো মুলতুবি রেখে বললাম,
-'এসো।'
পর্দা সরিয়ে এক অল্প বয়সী মেয়ে ঘরে ঢুকলো।
-'ছোটোবাবু কি এখন স্নান করবেন? নায়েবমশাই বললেন তার ব্যাবস্থা করে দিতে।'
-'হ্যাঁ, হ্যাঁ... চলো।'

*****

হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে যেতেই আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরলাম। ধীরে ধীরে মনে পড়ছে সকালের ঘটনা। আমি তাহলে এখন সেন বাড়ির এক আরামদায়ক ঘরে শুয়ে আছি। ভাবনাটা যেন টেনে উঠিয়ে বসিয়ে দিলো আমাকে। দুপুরে জম্পেশ খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু শুতেই চোখ লেগে গেছিলো। কতোক্ষন ঘুমিয়েছি কে জানে। বাইরেটা অন্ধকার। কোনো শব্দ নেই কোথাও কেমন যেন একটা গা ছমছমে পরিবেশ। আর একটা চাপা, একটানা একঘেঁয়ে ঝিঁঝিঁর সুর।
আবার বাইরে একটা খসখস আওয়াজ। এরা দেখছি আমাকে এক মুহুর্তও একা ছাড়ছে না। সবসময় নজর রাখছে না কি!
-'কে?'
-'এঞ্জে আমি ছোটোবাবু। নায়েবমশাই আপনাকে তৈরি হয়ে নিতে বললেন। কর্তাবাবুর সঙ্গে দেখা করতি যেতি হবে।'
-'ও আচ্ছা। হ্যাঁ আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।'
কাজের লোকটা নিঃশব্দে বেড়িয়ে গেলো। এদের চলা ফেরাতেও যেন কোনো আওয়াজ নেই। আর এসে থেকে নায়েব আর এই কাজের লোক-জন ছাড়া আর কাউকেই তো দেখছি না। বাড়ির আর কোনো সদস্য নেই না কি। এখন যাই আলাপ করে আসি 'কর্তাবাবুর' সঙ্গে। নিজেকে খানিক চাঙ্গা করতেই বেশ জোর একটা ঝটকা দিয়ে নামলাম বিছানা থেকে। এতোক্ষনে আমার লাগেজটার কথা মনে পরলো। এতোক্ষন নানা ঘটনার আকস্মিকতায় ব্যাগটার কথা ভুলেই মেরে দিয়েছিলাম। ব্যাগের খোঁজে এদিক ওদিক তাকাতেই ঘরের একপাশের একটা সেকালের ড্রেসিং টেবিলের সামনে সেটাকে আবিষ্কার করলাম। দেরি না করে তাড়াতাড়ি এক সেট জিন্স-শার্ট বের করে গলিয়ে নিলাম। বলাবাহুল্য আমার কাছে এগুলো ছাড়া আর অন্য কোনো ধরনের পোশাক ছিলো না যা এই জমিদার বাড়ির সঙ্গে যায়। গা ছমছমে অস্বস্তিটা কাটাতে শিষ তুলে এক আধুনিক গানের সুর ভাঁজতে থাকি। আসলে এরকম পরিবেশে আমি আস্তে আস্তে বেশ নার্ভাস হয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু চেষ্টা করছিলাম সেটা লুকোতে।
খানিকবাদে পর্দার ওপার থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এলো,
-'ভিতরে আসতে পারি?'
নায়েবমশাই এসে গেছেন।
-'আসুন...আসুন নায়েবমশাই। আমি তৈরি।'
আমার ইচ্ছাকৃত উঁচুস্বরের কথাবার্তা এই বরফ শীতল পরিবেশে বেখাপ্পা শোনাচ্ছিলো। আর আমি যতই উচ্চগ্রাম হচ্ছি এরা যেন ততটাই ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। নায়েবমশাই পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর হিমশীতল দৃষ্টি যেন আমার ভিতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলো। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলাম। কেমন যেন এক সম্মোহনি দৃষ্টি।
বরফকন্ঠে বললেন, 'চলুন।'
বলেই পেছন ফিরে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে গেলেন। আমি অগত্যা তাঁর পিছু নিলাম। উনি বারান্দা-অলিন্দ পাড় করে এগোচ্ছিলেন।
-'কর্তাবাবু খুবই অসুস্থ, হয়তো আর বাঁচবেন না। আপনার সন্ধ্যের চা-পানের আয়োজন ওখানেই করা হয়েছে।'
চারধারটায় আগেকারদিনের মতো ঝাড়বাতির আলো আঁধারি। কতক্ষন হাঁটছি জানি না।
চলতে চলতে একটা ঘোর লেগে গেছিলো। এমন সময় আবার নায়েব মশাইয়ের গলার আওয়াজ পেলাম। ঘোর কেটে দেখলাম আমরা একটা সুদৃশ্য ভারি পর্দা ফেলা বড় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। নায়েবমশাই পর্দার ওপারের কারুর উদ্দেশ্যে বলে চলেছেন,
-'আঞ্জে কর্তাবাবু ওনাকে নিয়ে এসেছি।'
-'ভেতরে আসুন।'
নায়েবমশাই আমার দিকে হাতের ঈশারা করে নিজে ঢুকে পরলেন ঘরের মধ্যে। ওনার পিছনে আমিও ঘরে ঢুকলাম। ভীষন অবাক হলাম এতো বড়ো আর অভিজাত শয়নক্ষ আমি আগে কখনও দেখিনি। মাথার উপরে সারা সিলিং জুড়ে যে ঝাড় তা আজকালকার দিনে লাখ টাকা খরচ করলেও মিলবে না। চতুর্দিকে বিলাস-ব্যাসনের সামগ্রী ছড়িয়ে। ঘরের মাঝখানের পালঙ্কের দিকে নজর গেলো। সুসজ্জিত সেই পালঙ্কে এক দীর্ঘকায় ব্যক্তি শুয়ে আছেন। তার শরীর বয়স ও অসুখে যথেষ্ট ভেঙে পরেছে। বিছানার পাশে সুদৃশ্য চেয়ারে একজন বসে আছেন। তার পোশাক বলে দিচ্ছে উনি ডাক্তারবাবু। বোঝা গেলো ভিতরে আসার অনুমতি ওনারই দেওয়া। একজন লম্বা ঘোমটা টানা মহিলা পালঙ্কে শায়িত ব্যক্তির মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বাতাস করছেন।
ডাক্তারবাবু ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে চুপ করতে বললেন। নায়েবমশাই আমাকে ঈশারা করে খানিক দুরের এক চায়ের টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করে নিজেও এগোলেন। এক শ্বেত পাথরের তৈরী সাদা ধবধবে চায়ের টেবিল আর সেই টেবিল ঘিরে কতকগুলি কাঠের কারুকাজ করা আরামদায়ক চেয়ার। শ্বেত পাথরের টেবিলের মাঝখানে সুন্দর টি-পট, পেয়ালা ইত্যাদি রাখা। বুঝলাম প্রথমে যে ভেবেছিলাম জমিদারির পড়ন্ত অবস্থা তা একেবারে ভুল।খানিকবাদে ডাক্তারবাবু এসে বসলেন চায়ের টেবিলে।
-'কেমন বুঝছেন?' নায়েবমশাইয়ের প্রশ্ন।
-'ভালো না। আজ রাত কাটবে কি না সন্দেহ। তবে ওনার বংশধরকে পাওয়া গেছে। এটা খুবই ভালো কথা।'
-'হ্যাঁ, অবশেষে পাওয়া গেছে। এতো যুগের অনুসন্ধান। না পাওয়া গেলে মরেও মুক্তি নেই। বংশধরের হাতের জল বলে কথা।'
-'এই বুঝি সেই জন?' ডাক্তারবাবু আমার দিকে চেয়ে বললেন। আমি একটু গুটিয়ে গেলাম।

পেয়ালায় সবার জন্য টি-পট থেকে চা ঢালতে ঢালতে নায়েবমশাই বলে চললেন,
-'ঠিকই ধরেছেন। কতো খোঁজ যে করা হয়েছিলো। অবশেষে যখন পাওয়া গেলো তারিনী আর কিছুতেই আসতে রাজী নয়। তার ছেলে মোহিনীকেও আমরা অনেক অনুরোধ করি। কিন্তু এমনই কপাল তার আয়ুও বেশীদিনের ছিলো না। কিন্তু সে নিজের স্ত্রী-র কাছ থেকে কথা নিয়ে যায় যে, ছেলেকে অন্তত একবার এখানে পাঠাবে। এতোদিনে সব ঠিক হবে।'
মাথা নেড়ে ডাক্তারবাবু সায় দিলেন।
আমি মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আমার বাবা-মা-ঠাকুর্দা প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছিলো। কিন্তু বিষয়টা পরিস্কার নয়। মা তাহলে আমাকে বাবার কাছে দিয়ে যাওয়া কোনো কথা রাখতে এখানে পাঠিয়েছে। তাই হয়তো আসার সময় মা-কে একটু বেশীই চিন্তিত মনে হচ্ছিলো। একটা গোঙানীর শব্দে আবার বর্তমানে ফিরে এলাম।
-'কর্তাবাবুর ঘুম ভেঙেছে মনে হচ্ছে।'
-'হ্যাঁ, হ্যাঁ চলুন। এতোদিনে কর্তাবাবুর সামনে চোখ তুলে দাঁড়াতে পারবো। আজ ওনার মুক্তি। আর এতো কষ্ট পেতে হবে না।'
শশব্যাস্ত হয়ে নায়েবমশাই আর ডাক্তারবাবু এগিয়ে গেলেন পালঙ্কের দিকে। মোহাবিষ্ট আমি তাদের অনুসরন করলাম। অসুস্থ ব্যক্তির রোগশয্যার খানিক দুরে নায়েবমশাইয়ের ঈশারায় দাঁড়িয়ে গেলাম। ডাক্তারবাবু এগিয়ে গেলেন পালঙ্কে শায়িত ব্যক্তির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন,
-'কর্তাবাবু উনি এসেছেন।'
একথা শুনে কর্তাবাবু যেন খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে বসতে গেলেন কিন্তু পারলেন না। উল্টে কাশতে শুরু করলেন। ডাক্তারবাবু জড়িয়ে ধরে সামলালেন তাঁকে। কিন্তু কাশি কিছুতেই থামছে না। কাশির দমকে তাঁর চোখ ঠেলে বেড়িয়ে আসতে চাইছে যেন। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি সোজা আমার দিকে। জড়ানো গলায় যেন কিছু বলতে চাইছেন। পাখা ফেলে রেখে সেই মহিলা একটা ছোটো রুপোর বাটিতে করে খানিকটা জল আমারদিকে এগিয়ে দিলেন। তাতে একটা ছোট রুপোর চামচ ডোবানো।
-'তাড়াতাড়ি এই গঙ্গাজলটা কর্তাবাবুকে খাইয়ে দিন ছোটোবাবু।'
পিছন থেকে নায়েবমশাইও তাড়া দিলেন,
-'হ্যাঁ ছোটোবাবু, দেরি করবেন না। বংশধরের হাতের এই গঙ্গাজল পাওয়ার লোভে উনি মুক্তি পাচ্ছেন না আজ বহু বছর। নিন তাড়াতাড়ি করুন।'
এহেন পরিস্থিতিতে আমি একদমই হতচকিত। নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রন নেই। একদিকে মৃতপ্রায় বৃদ্ধের কাশির দমক, গোঙানী। আর দু দিক থেকে দুজনের তাড়ায় যন্ত্র চালিতের মতো গঙ্গাজলের বাটিটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে ডাক্তারবাবু সরে দাঁড়ালেন। দেখলাম অসুস্থ শরীরের হঠাৎ উত্তেজনায় কর্তাবাবুর চোখ কপালে উঠে গেছে। আবার সবার তাড়া শুনতে পেলাম পিছন থেকে,
-'গঙ্গাজলটা চামচে করে ওনার মুখে দিয়ে দিন তাড়াতাড়ি।'
আমিও আর দেরী না করে এক চামচ গঙ্গাজল বৃদ্ধের হা মুখে ঢেলে দিলাম। যেন এটারই অপেক্ষায় ছিলেন। ওনার শরীরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগলো। বিকৃত স্বরে শুধু উচ্চারন করতে পারলেন 'মুক্তি' আর মাথাটা একদিকে ঢলে পড়লো।
পিছন থেকে কেউ যেন বলে উঠলো,
-'ভবানী সেন অবশেষে মুক্তি পেলেন।'
'ভবানী সেন' নামটা শুনেই আমি তড়িৎ গতিতে পিছনে ফিরলাম। কারন আমি জানি ভবানী সেন বহু বছর আগেই মারা গেছেন। কিন্তু পিছন ফিরে আমি কাউকে পেলাম না। নায়েবমশাই, ডাক্তারবাবু, সেই মহিলা- কেউ না। তাদের কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার সামনে ফিরলাম। কোথায় সেই পালঙ্ক আর পালঙ্কে শায়িত ভবানী সেন। হঠাৎ দেখলাম আমি একটা বিশাল ভাঙা বাড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। চারদিকে ঝোপ-ঝাড় ইঁট-পাথর, ভাঙা দেওয়াল। একটা আতঙ্ক আমাকে এসে গ্রাস করলো। আমি বেড়োনোর দরজাটা খুঁজতে লাগলাম পাগলের মতো। পাথরে আমার পা আঁচড়ে গেলেও থামলাম না। আমাকে যেভাবেই হোক এই গোলক ধাঁধা থেকে বেড়োতে হবে। বেড়োতেই হবে।

*****

চোখে রোদ পড়তেই হুঁশ ফিরে এলো। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালাম। সামনে কতকগুলো কৌতুহলী মুখ। এরা কে? এক বৃদ্ধা এগিয়ে এলেন,
-'এই তোরা আগে ওকে কিছু খেয়ে নিতে দে। এখন যা।'
সবাই চারপাশ থেকে সরে গেলেও সেখান থেকে চলে গেল না ৷ ততক্ষনে উঠে বসেছি। চারধার দেখে বুঝলাম একটা গ্রাম্য চায়ের দোকানের মধ্যে একটা কাঠের বেঞ্চে শুয়েছিলাম এতোক্ষন। পা-টা টানতে গিয়ে দেখলাম টনটনে ব্যাথা। তাকিয়ে দেখি অনেকটা ফুলে আছে। ফোলাটার ওপর কিছু একটা ওষুধের প্রলেপ। সামনে খাবার দেখে খিদেটা চনমনিয়ে উঠলো। আগে খাবারের প্লেটটা টেনে নিলাম। পেট ভরতে চায়ের কাপ হাতে নিলাম। চা খেয়ে একটু ভালো লাগছে। মাথাটা যেন কাজ করছে। আস্তে আস্তে মনে পড়ে যাচ্ছে সব। এ কি দেখলাম! ভীষন বিভ্রান্ত লাগছে। কালকের ঘটনাগুলো কি সত্যি না হ্যালুশিনেশন।
বৃদ্ধা জিগ্যেস করলো,
-'এখন শরীর কেমন লাগছে? কাল রাতে কি হয়েছিলো বাবা? কোথা থেকে এসেছো তুমি?'
আমি তাকে ঘুরিয়ে জিগ্যেস করলাম,
-'তার আগে বলো আমি এখানে এলাম কি করে?'
বৃদ্ধা বললো,
-'জানি না তো বাবা। এই দোকানের কিছু দুরে তুমি অঞ্জান হয়ে পরেছিলে। আমি সকালে দোকান খুলতে এসে তোমাকে দেখি। তারপর লোক ডেকে তোমাকে এখানে নিয়ে আসি।' একটু থেমে আবার জিঞ্জেস করলো,
-'কি হয়েছিলো?'
আমি কালকের সমস্ত ঘটনা তাকে বললাম। কিছুদুরে দাঁড়িয়ে স্থানীয় লোকেরাও শুনলো আমার বিচিত্র অভিঞ্জতার কাহিনী।
আমার কাছ থেকে সব শুনে সবাই মাথা নাড়লো,
-'বুঝেছি বাবুজি আপনি সেন বাড়িতে গিয়ে পড়েছিলেন। ওই বাড়ি তো এখন ভাঙা ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে আছে। কেউ থাকে না। সব মরে গেছে। কেউ যায় না ধারে কাছে। নানা রকম ছায়ামুর্তি দেখা যায়। মানুষের কথা শোনা যায়। নানা রকমের আওয়াজ আসে। সবাই বলে ভবানী সেনের অতৃপ্ত আত্মা বংশধরের হাতের জল পাওয়ার আশায় ওই ভাঙা সেন বাড়িতে ঘোরে। আপনার মা মনে হয় এতোসব জানতেন না। আপনার বাবাকে দেওয়া কথা রাখতেই আপনাকে একবারের জন্য পাঠিয়েছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন পরের প্রজন্ম এখনও সেন বাড়িতে বাস করে। কারন আজকালকার যুগে কে আর এসব ভাববে।'
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
-'আর কখনও হয়তো ভবানী সেনের অতৃপ্ত আত্মাকে দেখা যাবে না।'
সবাই আমার কথার সমর্থনে মাথা নাড়লো। গতকাল রাতেই তার অসম্পুর্ন ইচ্ছা পুর্ণ হয়েছে। মুক্তি পেয়েছে তাঁর আত্মা।

** * * *


এবার আমাকে ফিরতে হবে। আমার লাগেজটার কথা এতোক্ষনে মনে পরলো। কয়েকজনকে সঙ্গে করে আবার গেলাম সেন বাড়ির দিকে। দেখে চমকে উঠলাম। চোখের সামনে যে বিশাল ধ্বংসস্তুপটা দেখলাম সেটাকে গতকালের সুসজ্জিত বাড়িটার সাথে কোনোভাবেই মেলাতে পারছিলাম না। ভাঙা সিংহদরজাটার কাছে ভাঙা ফিটনগাড়িটাকে পড়ে থাকতে দেখলাম। সবাইমিলে একটু খুঁজতেই এক ঝোপের মধ্যে আমার ব্যাগটাকে পাওয়া গেলো।
এই ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়েও আমার যেন সব অবিশ্বাস্য লাগছে। এও সম্ভব এইতো মাত্র আট-দশ ঘন্টা আগেও....

গ্রামবাসীরা সবাই আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে এলো। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে ট্রেনে উঠে তাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লাম।

~~~~~~~~~
ভাষাপথ অ্যাপটি ব্যবহার করবার জন্য ধন্যবাদ। এই অ্যাপটি ভালো লাগেল, অবশ্যই ফাইব ষ্টার রেট দেবেন এবং কমেন্ট করে আপনাদের মতামত জানাবেন এবং সকলের সাথে শেয়ার করে নেবেন।