নগরকীর্তন ৷ পরিচালক : কৌশিক গাঙ্গুলী




চলচ্চিত্র

নগরকীর্তন


'নগরকীর্তন' অর্থাৎ কি না নগরের পথে পথে ঈশ্বরের নামগান করা। ঈশ্বর কে? তিনি আছেন অন্তরেই, তিনি আছেন প্রেমময়রূপে, তিনি আছেন দরবিগলিত কানায় কানায় ফুটে ওঠা হৃৎকমলে।


আবার গভীরে ভাবলে এ প্রেমের জন্ম জ্বালা থেকে। কোথাও এ প্রেম আবিষ্কার। কখনো এ প্রেম হারিয়ে খোঁজা। কখনো তীব্র এ প্রেম নামগানের আভাসে অন্য প্রেমের গল্প বলে। অন্য প্রেমের কীর্তন গায়। যে মন মেয়ে হতে চায়, ঈশ্বরের অসতর্কতায় সে শরীরটা পুরুষ হয়ে যায়। আর হাহাকারে ভরা এ নারীমন তীব্রভাবে রূপান্তর চায়। নারীদেহে রূপান্তর। অন্তরে নারী বাইরে পুরুষ নয়। অন্তর ও বাহিরে শুধুই নারী।
কিন্তু সে কীর্তন গাইবে কে? অন্তরে রাধাভাবে তাড়িত নিমাই অস্থির হন যখন, কীর্তন মাত্রা পায় আরেক। গাওয়া হয় জীবনের গান।



আমরা আকুল হই। আমরা মুচড়ে ওঠা বুককে শান্ত করি আর ভাবি ভালতে বাস করা তো অন্যায় নয়!
আমাদের স্বল্পসংখ্যক যে শিল্পীরা এ নিয়ে ভাবান, কৌশিক গাঙ্গুলী যে তাদের অন্যতম, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
এ কীর্তন অন্য প্রেমের। অন্য ভালবাসার গল্প। আগলভাঙা এমন ভালবাসা যাকে আমাদের সঙ্কীর্ণ সত্তা 'মেনে' নেয়, 'মনে' নেয় না। ক'দিন আগে লিখেছিলাম এ নিয়ে।
যাক সে কথা।
ছবিতে আসি।

গ্রামের রূপান্তরকামী পরিমল তার ব্যর্থ ভালবাসাকে পুড়িয়ে উড়িয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে আসে কোলকাতা নগরীতে। এ বাঁচা যে সুখের নয়, কুসুমাস্তীর্ণ নয়, বোঝে সে। চলতি কথায় 'হিজড়ে' সে। গালভরা রূপান্তরকামী টামী তোলা থাক অভিধানে, ঠাণ্ডা ঘরের সাহিত্য-শিল্পে। শহরে পরিমল হয় পুঁটি। ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর সামনে তালি বাজিয়ে তার রোজগার। তার জীবনচক্র আরো কিছু হিজড়ের সঙ্গেই। দুচোখে কিন্তু স্বপ্ন আর ভালবাসা মাখা তার।
নবদ্বীপের বৈষ্ণব পরিবারের ছেলে মধু জীবিকার তাগিদে আসে কোলকাতায়। চাইনিজ এক হোটেলের ডেলিভারি বয় সে। অবসর কাটে বাঁশুরিয়া হয়ে, কীর্তনের আসরে।
এরা যে পরস্পরকে ভালবাসবে, তা তো নিয়তিতাড়িতই ছিল। পুঁটির সহজ অভিব্যক্তি মধুকে স্বাভাবিকভাবে ভাবতে শেখায় এমন সম্পর্ককে। ভালবাসা গাঢ় হয় তাদের।
পালায় তারা।
বাঁচতে চায় তারা।
দেখা করে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় নামের যুগান্তরের স্পর্ধাটির সাথে। আরো সহজ হয়। আরো স্বপ্ন দেখে। যদিও বোঝে বহু কাঁটায় বিক্ষত হওয়াই তাদের নিয়তি।



অবশেষে 'নিয়তি' নামের এই ব্যাটাচ্ছেলে কোথায় যে নিয়ে যায় এদের! কীসব যে ঘটে যায়! কেন যে মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়ার মধ্যে দুরতিক্রম্য ব্যবধান গড়ে ওঠে।

ভেঙেচুরে দীর্ণবিদীর্ণ হয়ে ক্যাথারসিস ঘটে মধু'র।
এ মোক্ষণ এ ছবির চূড়ান্ত দৃশ্য। হয়তো বা সেরা দৃশ্য।

এ ছবি উৎসর্গীকৃত ঋতুপর্ণ ঘোষ-কে। এমন ছবি, এমন ভাবনা আর কাকেই বা উৎসর্গ করা যেত?
চারটি দিক থেকে চারটি জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী এ ছবিতে ঋদ্ধি সেন সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন। দর্শক! কেন যে এমন হয়েছে তা ছবিটি না দেখলে কেমন করেই বা বুঝবেন আপনি? বাকি ঋত্বিক। জাতীয় পুরস্কার না-ই বা পেলেন, জাতির ভালবাসা পেয়ে গেছেন তিনি। এঁরা এ ছবির স্তম্ভ।
ছোট্ট রোলে বিদীপ্তা অত্যন্ত সাবলীল।
বাকি এ ছবির সমস্ত অন্যরকম মানুষগুলো যাদের যাপন নিয়ে আমরা সংস্কার থেকে বেরোতেই পারিনি, তাদের বাঁচতে চাওয়ার এবং ভালবাসতে চাওয়ার সহজাত প্রবৃত্তির প্রতি সমর্থন ও সহমর্মিতা রইলো।
আর কৌশিকবাবু সম্পর্কে সত্যিই কী বা বলার!! বিশেষণ টিশেষণের অপেক্ষা ইনি রাখেন না।
"তুলনা দেখিনে আর, উপমা দেব কী!" ❤



পরিশেষে, ছবিটি দেখতে বসে বুঝেছি স্বপ্নময়দা'র সেই অবিস্মরণীয় 'হলদে গোলাপ' যার ভাষা নিয়ে আমি নতজানু থাকি, তা কতভাবে সহায়তা করলো আমাকে অনেক চলতি ভাষা যা এঁরা ব্যবহার করেন, তা বুঝতে। চরিত্রগুলোকেও অত্যন্ত চেনা লাগলো!
আমায় অন্যভাবে ভাবতে শেখানো সেই স্বপ্নময়দার-ও পদস্পর্শ করি। 🙏

--------------------
ভাষাপথ অ্যাপটি ব্যবহার করবার জন্য ধন্যবাদ। এই অ্যাপটি ভালো লাগেল, অবশ্যই ফাইব ষ্টার রেট দেবেন এবং কমেন্ট করে আপনাদের মতামত জানাবেন এবং সকলের সাথে শেয়ার করে নেবেন।